পায়ে পায়ে দাঁড়ি কমা নিয়েই অগ্রসরমান কবি কবীর হোসেন

প্রতিনিধি | সমালোচনা

বুধবার ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮|১৯:৩৭:১৩ মি.



তাজ ইসলাম

আমার কলম থেকে রক্ত বেরুচ্ছে। 
প্রথমে ভেবেছিলাম 
খুব সহসাই দেখতে পাবো
কালো, নীল, সবুজ অথবা সহজাত লাল কালি।
কিন্তু না উনিশশ' একাত্তর সাল থেকে ক্রমাগত
 কেবল রক্তপাতই হচ্ছে। (আমার কলম থেকে) 
বুকের রক্তক্ষরণে কবিতার পঙক্তির রক্তিম বর্ণের কবির নাম কবীর হোসেন। পায়ে পায়ে দাঁড়ি কমা এটি তার কবিতার পঞ্চম গ্রন্থ। তার কবিতায় লিখা হয় মানুষের কথা, মানুষের যাতনার কথা, সমাজ ও সমাজের অসঙ্গতির কথা। তিনি লিখেন দেশ ও দশের কথা।
মানুষ যখন মানবিক গুণ হারায় তখন তিনি বেদনায় কুঁকড়ে যান, দেশের অমঙ্গলের আশংকায় শংকিত হন, সমাজের অহিতে তিনি মর্মাহত হন। কবির দৃষ্টিতে সকল অন্যায় অসঙ্গতি প্রতিরোধের একমাত্র সমাধান মানুষকে মানুষ হওয়াতেই। এবং মানুষকেÑ
‘মানুষ হতে হলে
নিজের যা কিছু আছে
তাকে তাই নিয়ে
শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।’ (শিরোনামহীন-১)।
মানুষ যদি মানুষ হয়ে যায় তখন তার ভেতরে থাকে না লোভ, ক্রোধ, হিংসা জিঘাংসা। তার কাছে অর্থ, বিত্ত, সম্পদ জৌলুসের চেয়ে চিত্তের সুখেই সুখি হন তিনি। তার থাকে না অপ্রাপ্তি বা দুঃখবোধ। সহজেই নিজেকে মনে করেন একজন সুখি মানুষ। একজন কবির এটি বড় উপলব্ধি।
"যেহেতু আমার কোন দুঃখবোধ নেই
সেহেতু পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধনীদের সাথে 
আমার নামটিও যুক্ত করে নাও।’ (ধনীর তালিকায় আমার নাম)

মানুষের থাকে নানা চাওয়া। এই চাওয়ার বহুমাত্রিকতা আছে। এই চাওয়া কেন্দ্রিক স্বপ্নে ঘোর পাক খায় একজন ব্যক্তি। স্বপ্নের কথা কেউ জানে না। হৃদয়ে তড়পায় স্বপ্ন। সাধারণের স্বপ্ন অপ্রকাশিত থাকলে ও সৃষ্টিশীল মননের স্বপ্ন প্রকাশ পায় বিভিন্নভাবে। কেউ প্রকাশ করেন তুলির আঁচড়ে, কেউ গানের সুরে, শব্দশিল্পী তার স্বপ্নকে প্রকাশ করেন শব্দের যাদুকরি বুননে। কবীর হোসেন কবি। তিনি তার মনের গভীরের কথা প্রকাশের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন তার শব্দের বুননে। প্রাত্যহিক জীবনে তার স্বপ্নের কথা বিবৃত করেন স্বপ্ন সিরিজে। তার হৃদয় গভীরে গ্রোথিত স্বপ্নটি। এই স্বপ্নটি একদিনের নয়, বহুদিনের লালিত স্বপ্ন। এই স্বপ্নটি একজনকে কেন্দ্র করে। তিনি বর্ণনা করে যাচ্ছেন সিরিজ একও দুইয়ে। পরিশেষে তার স্বপ্নের সমাপ্তি সুখকর নয়। আহত হৃদয়ে সে স্বপ্নের সমাপন। কবির কাব্যেই শুনি সে বর্ণনা তারপর বহুদিন হয় সেই স্বপ্নটি আর দেখি না। বুঝতে পারিÑ 
তোমার সাথে সম্পর্কের টানাপোড়েনই ছিল এই দুঃস্বপ্নের কারণ।
এখন তুমিও নেই, স্বপ্নটিও নেই।’ (তুমি নেই স্বপ্ন নেই)
 বস্তুত আমরা যে স্বপ্ন সিরিজের কথা বলছি এটি একটি দুঃস্বপ্ন সিরিজ। যা কবির কথায় স্পষ্ট। কবিরা এভাবেই স্বপ্ন আর দুঃস্বপ্নের কথা বলে যান অকপটে তার পাঠক সমীপে। আর তখন তা হয়ে ওঠে কাব্য।

পাখি কবির হোসেনের কবিতার বিষয় হয়ে আসে, আসে উপমা হয়ে, কখনো চিত্রকল্পের আবহে কবি নিজেই হয়ে যান এক উড়ন্ত পাখি। পাখি কবিকে কখনো চিন্তিত করে, কখনো পাখি হয়ে পেতে চান মানবিক দুঃখ কষ্ট থেকে পরিত্রাণ। পাখি কবির প্রিয় অনুসঙ্গ। তবে একটি কবিতার বইয়ে একই বিষয়ের পৌনঃপনিক আর্বতন কবির চিন্তা শক্তির প্রাবল্যতার পরিপন্থি। কবিকে সজাগ থাকা জরুরি যেন শিল্পের দৈন্যতা প্রকট না হয়। পাখি যেভাবে ঘুরেফিরে এসেছে এতে তার পাখি প্রীতির পাশাপাশি মুদ্রাদোষের চিহ্নও প্রকাশ হয়ে পড়েছে। কবিকে উপমায় বৈচিত্র, চিত্রকল্প বিনির্মাণে পারঙ্গমতা, বিষয় বস্ত গ্রহণে অভিনবত্ব পাঠক হৃদয়ে তার শক্ত অবস্থানে সহায়তা করবে। মেধাবী কবির জন্য এ বিষয়গুলো স্মরণে রাখা কর্তব্য। আমরা এই বই পর্যালোচনায় বলতে পারি কবি কবীর হোসেন একজন পাখি প্রেমিক কবি। তার অনেক দৃষ্টান্ত থেকে পাঠকের জন্য উদ্ধৃত করছিÑ
‘বুকের ভেতর বাস করে যাযাবর পাখি
রোজ তার আকাশে ওড়ার শখ
যতই না ভালবাসি, খিল আটকাই।
... বনের ডাক পেলে ছুটে যায় পাখি
মানুষের যতই থাক তাকে প্রয়োজন।’ (যাযাবর পাখি)
কবীর হোসেনের কবিতায় পাখি ছাড়াও প্রকৃতির প্রজাপতি, ফড়িং, নদী, নদীর ঢেউ, গাছ ঘাস নারীকে চিত্রিত করেছেন কবির কল্পনা মিশ্রিত রঙে। কবীর হোসেন প্রকৃতি নিবিষ্ট কবিদের একজন। তাই তার কষ্টের সাড়ায় অনুভবের স্বীকারোক্তিÑ
 ‘আমি তো দেখেছি ঠিক কষ্টের ডাক পেলে ছুটে আসে নদী। 
বুকের ভেতর উছলে ওঠে বিধ্বংসী নদীরা।’ (বিজ্ঞানী)
‘পায়ে পায়ে দাঁড়ি কমা’ কবির পঞ্চম কাব্য গ্রন্থ। পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ হিসেবে কবির কাছে পাঠকের প্রত্যাশার পরিমাণও বেশী। সে চাহিদার জোগান দিতে কবিকে আরো পরিশ্রমী ও শিল্প সচেতন হওয়াই আবশ্যক।

পায়ে পায়ে দাঁড়ি কমা
কবীর হোসেন।
প্রচ্ছদ এঁকেছেন ড. শেখ মনির উদ্দিন।
প্রকাশনায় শব্দনীড়, ঢাকা।
প্রকাশকাল বইমলে ২০১৮।
৫৮ টি ছোট বড় কবিতা নিয়ে ৬৪ পৃষ্ঠার উন্নত কাগজ, ঝকঝকে ছাপার এ বইটির মূল্য রাখা হয়েছে মাত্র ১০০ টাকা। বইটি প্রচার ও পাঠকপ্রিয়তা কামনা করি সতত।
 

পাঠকের মন্তব্য Login Registration