নজরুল ইসলামের নাট্যসাহিত্য

প্রতিনিধি | সমালোচনা

শুক্রবার ১ মার্চ ২০১৯|১৯:১০:০০ মি.



সৌরভ শাখাওয়াত

কবি কাজী নজরুল ইসলাম(১৮৯৯–১৯৭৬) ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী বাংলা সাহিত্যের একজন মহীরুহ সদৃশ্য ব্যক্তিত্ব। বিশ শতকের প্রথমার্ধ তাঁর প্রতিভার উত্তেজনা ও সুজনশীলতায় উজ্জ্বল হয়েছে বাংলা কবিতা, গান, উপন্যাস, প্রবন্ধ, সাংবাদিকতা, রাজনীতি, গ্রামোফোন, বেতার, চলচ্চিত্র , মঞ্চ ও নাটক। নজরুলের প্রধান পরিচয় কবি হিসেবে। কিন্তু তিনি নাট্যকারও। তাঁর রচিত নাটক নাটিকা ও নাট্যধর্মী রচনার সংখ্যাও কম নয়।

১৯১০ খ্রিস্টাব্দ হতে কিশোর বয়সে লেটোদলের পালা –নাট্য থেকে শুরু করে বিশ শতকের আধুনিক সংবাদ সাময়িকী,মঞ্চ, বেতার, গ্রামোফোন কোম্পানীর রেকর্ডেও জন্য অনেক নাটক–নাটিকা ও নাট্যধর্মী আলেখ্য রচনা করেছেন। তাঁর নাট্যকার হিসেবে এই প্রয়াস অব্যাহত থাকে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে অসুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত।

নজরুল রচিত উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে রয়েছে আলেয়া, মধুমালা, বিদ্যাপতি, পুতুলের বিয়ে, জাগো সুন্দর চির কিশোর, শ্রীমন্ত, বিষ্ণুপ্রিয়া, বনের বেদে, ঝিলিমিলি, সেতু–বন্ধ, ভূতের ভয় ইত্যাদি। কলকাতার সুধী ও নাট্যমহলে নজরুল নাট্যকার হিসেবে পরিচিত হন ‘নওরোজ’ পত্রিকার মাধ্যমে ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে। ওই বছরে অর্থাৎ ১৩৩৪ সালের আষাঢ় সংখ্যা মাসিক ‘নওরোজ’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় নজরুলের আধুনিক নাট্যরীতির একাংকিকা ‘সারা ব্রিজ’। ‘সারা ব্রিজ’ পরে ‘সেতু–বন্ধ’ নামকরণ করা হয়। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে (১৩৩৭ বঙ্গাব্দ) নজরুলের তিনটি একাংকিকা নিয়ে ‘ঝিলিমিলি’ নামে নাট্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। গ্রন্থভুক্ত নাটকগুলো ছিল ঝিলিমিলি’ সেতু–বন্ধ শিল্পী।

কিছুদিন পরই ‘ঝিলিমিলি’র দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় সংস্করণে ‘ভূতের ভয়’ নামে একটি নতুন একাংকিকা অন্তর্ভুক্ত হয়। ‘ভূতের ভয়’ নামে একটি নতুন একাংকিকা অন্তর্ভুক্ত হয়। ‘ভূতের ভয়’ নাটকের রচনার সাল তারিখ সম্পর্কে সঠিক তথ্য এখনো অনুদঘাটিত। আবদুল কাদির লিখেছেন, ‘ঝিলিমিলি’ নাট্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত চতুর্থ নাটিকা ‘ভূতের ভয়’। রফিকুল ইসলাম লিখেছেন, ‘ভূতের ভয়’ নাটকটি ‘ঝিলিমিলি’র দ্বিতীয় সংস্করণে সংযোজিত হওয়ার কথা। কিন্তু ঝিলিমিলি’র দ্বিতীয় সংস্করণ কবে প্রকাশিত হয় তার উল্লেখ নেই।

এই নাটকের আখ্যান গড়ে উঠেছে সাগর পারের ভূত–প্রেত পিশাচের কবল থেকে দেশকে উদ্ধারের কাহিনী নিয়ে। দেবাধিপতি জানায় যে, নিজেদের ভুলের কারণে শতবছর আগে সাগরপারের ভূতেরা দেবলোক জয় করেছে। তাদের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করার আহ্বান জানান তিনি। তার সভায় উপস্থিত বিপ্লব কুমার দেবাধিপতির আহ্বানে সাড়া দিয়ে জানায় যে, ভূতকে মারের চোটে ভাগাতে হবে অর্থাৎ সশস্ত্র সংগ্রাম করতে হবে। কিন্তু দেবাধিপতি তার প্রস্তাবে দ্বিমত পোষণ করে। দেবলোকে নতুন করে ভূত নিবারণী সভা হয়। নতুন সভাপতি হয় জয়ন্ত। জয়ন্তও বিপ্লবকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ভূতের বিরুদ্ধে লড়াই করার পরামর্শ দেয়। কিন্তু জয়ন্ত জানায় বিপ্লব কুমারের পথকে শ্রেষ্ঠ পথ বলে গ্রহণ করার মত বিশ্বাস তার জন্মায়নি। স্বাহা দেবী বিপ্লব কুমারের সশস্ত্র প্রতিরোধের নীতির প্রতি সমর্থন জানায় এবং তার পেছনে শক্তি হিসেবে কাজ করার কথা জানায়।

শুরু হয় বিপ্লব কুমারের নেতৃত্বে ভূতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। যুদ্ধে দেবসেনাদের অস্ত্র ফুরিয়ে যায়। ভূতের মায়াজাল দিয়ে বন্দী করে দেবসেনাদেরকে। একা যুদ্ধ করতে থাকে বিপ্লব কুমার। এক সময় ভূতের আক্রমণে বিপ্লব কুমার আহত হয়। ঠিক এ সময় এসে হাজির হয় স্বাহাদেবী তার দলবল নিয়ে। বিপ্লব কুমার মৃত্যুর আগে স্বাহদেবীকে আত্মত্যাগের অভয় মন্ত্র ও শক্তি দিয়ে যায়। স্বাহাদেবী বিপ্লবের ব্রতকে গ্রহণ করে ভবিষ্যতে দেশকে ভূতের কবল থেকে রক্ষার জন্য।

‘ভূতের ভয়’ এর কাহিনী রূপক। এই কাহিনীর আড়ালে নজরুল তাঁর রাজনৈতিক দর্শনকে তুলে ধরেছেন। উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে সশস্ত্র সন্ত্রাসবাদীদের নীতি ও পথ বনাম মহাত্না গান্ধীর নেতৃত্বে পরিচালিত অহিংস নীতির দ্বন্দ্ব এ নাটকে প্রতিফলিত হযেছে। নজরুল সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবের আন্দোলনকেই মহীয়ান করে তুলেছেন। সেই সঙ্গে এ আন্দোলনের অংশীদার করেছেন নারী সমাজকেও। নাটকের পরিণতি বিয়োগান্তক হলেও রাজনৈতিক চেতনায় পুষ্ট।

নজরুলের ‘আলেয়া’ একটি রুপক নাটক। এ নাটকের তিনটি প্রধান নারী চরিত্র। কৃষ্ণা চিরকালের ব্যর্থ প্রেমিকা, জয়ন্তি তেজীয়ান রাণী, শক্তির প্রতীক আর চন্দ্রিকা চিরকালের কুসুম পেলব প্রাণ চঞ্চল নারী কৃষ্ণা রাজা সীনকেতুর প্রধানমন্ত্রী। নজরুল নারীকে ক্ষমতায়ন করেছেন এ নাটকে কৃষ্ণার মাধ্যমে। যুদ্ধ নয়, অস্ত্র নয়, হিংসা দ্বেষ নয়, প্রেমই শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়’ আলেয়া’ নাটকে।

নজরুল নিজেই ছিলেন এক চির শিশু। তাঁর বুকের ভেতর কোথায় যেন লুকিয়ে ছিলো এক অবাক শিশু যার ধরন–ধারণ শিশুর মতোই অবারিত উল্লাস, অফুরন্ত আনন্দে ভরপুর। তাঁর রচিত শিশু কিশোর নাটকে জাতিগঠনে, দেশগঠনে, কল্যাণকর সমাজব্যবস্থা গঠনে শিশুর মনের মুক্তি তিনি খুঁজেছেন। ছোটদের জন্য তাঁর রচিত নাটক কানামাছি, জাগো সুন্দর চির কিশোর, জুজুরুড়ির ভয়, নাবার নামতা পাঠ, পতুলের বিয়ে উল্লেখযোগ্য।

‘পুতুলের বিয়ে’ ১৯৩৩ সনে রচিত নজরুলের শিশু নাটিকা। এ নাটকে তিনি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, হাসি ঠাট্টা, লোকসংস্কৃতি তুলে ধরেছেন। ১৯৪৯ সনে রচিত ‘জাগো সুন্দর চির কিশোর’ নাটকের কংকন ও কল্পনা নামে দুটি চরিত্র রয়েছে যারা অন্যদের নিয়ে সত্য সুন্দর ও কল্যাণকর পৃথিবী গড়তে চায়।

১৯৩৫ সালে নজরুল রচনা করেন লোকগাঁথা ভিত্তিক নাটক ‘শ্রীমন্ত’। এ নাটকের নায়িকা দীপালিকে সৃষ্টি করা হয়েছে ফুলের সৌন্দর্য আর হৃদয়বতি হিসেবে। সিংহল কন্যা দীপালি শেষ পর্যন্ত ধনপতি সওদাগরের পুত্রবধূ হয়ে আসে সজল শ্যামল বাংলাদেশে ১৯৩৬ সনে রচিত নজরুলের ‘বিদ্যাপতি’ নাটকের কাহিনী গড়ে গড়ে উঠেছে ত্রিভুজ প্রেমকে ঘিরে। এ নাটকে রাণী লছমী রাজকবি বিদ্যাপতির পেমে পড়ে। অন্যদিকে অনুরাধাও বিদ্যাপতিকে গোপনে ভালবাসে। কিন্দু শেস পর্যন্ত কেউই পায় না বিদ্যাপতিকে। বিদ্যাপতি দেহজ প্রেমের ঊর্ধ্বে উঠে নদীতে আত্মবিসর্জন দেয়। সে সঙ্গে রানী লছমী এবং অনুরাধাও একই পথ বেছে নেয়।

‘বিষ্ণুপ্রিয়া’ নাটকের বিষ্ণুপ্রিয়া চরিত্রটি প্রতিপ্রাণা নারীর প্রতীক। ‘মধুমালা’ লোকগাঁথা ভিত্তিক নাটক। নাটকে মধুমালা চিরন্তন প্রেমিকা, যেন এক স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা। স্বামী এবং সতীন কাঞ্চনমালার সংসারকে সুখী করার জন্য সে আত্মত্যাগের পথ বেছে নেয়। অন্যদিকে কাঞ্চনমালাকে পাওয়া যায় প্রতিপ্রাণা নারী হিসেবে।

নজরুলের ক্ষুদ্র নাটিকা ও রেকর্ড নাট্য রয়েছে সেগুলো মধ্যে ‘পটু ও খুকু’ , কে কি হববিল, চারকালার শ্বাশুড়ি ও পুত্রবধূ, বিয়েবড়ি, বাসন্তিকা, ঈদুল ফিতর, পুরনো বলদ ও নতুন বৌ, শাল পিয়ালের বনে, ঈদ, বিলেতি ঘোড়ার বাচ্চা উল্লেখযোগ্য।

নজরুলের নাটক দর্শককে দেখিয়েছে জীবনের সর্বক্ষেত্রে এমনকি বিপ্লবে, যুদ্ধে, স্বাধীনতা সংগ্রামে পুরুষের পাশাপাশি নারীর অংশগ্রহণ প্রয়োজন। দেশাত্মবোধের জাগরণ ও মহত্তর কল্যাণবোধের উত্তোরণের জন্যে, উপেক্ষিত লাঞ্ছিত ও অত্যাচারিত আত্মবিস্মৃত ব্যক্তিকে চেতনাসম্পন্ন করতে চেয়েছে নজরুলের নাটক। চিরঞ্জীব হোক নজরুলের নাট্যসাহিত্য।

ড. সৌরভ সাখাওয়াত : বিভাগীয় প্রধান, সাধারণ শিক্ষা বিভাগ, সাদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ

পাঠকের মন্তব্য Login Registration