আধুনিক এক চিত্রকর ও রুচির নির্মাতা

প্রতিনিধি | সমালোচনা

সোমবার ৯ মার্চ ২০২০|১৭:১৩:০৩ মি.


আবুল হাসনাত

কাইয়ুম চৌধুরী বাংলাদেশের চিত্রকলা আন্দোলনে এক অসামান্য চিত্রকর ছিলেন। প্রথম প্রজন্মের চিত্রশিল্পীদের মধ্যে আবহমান বাংলার লোকঐতিহ্য ও লোকজীবনের রূপায়ণ তাঁর তুলিতেই সর্বাপেক্ষা প্রাণবন্ত ও সজীব হয়ে উঠেছিল। ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সমন্বয়ে তিনি এদেশের মানুষের স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা, নিসর্গ ও নদীর নানা অনুষঙ্গ ধারণ করে এমন এক ভুবন নির্মাণ করেছিলেন, যা হয়ে উঠেছিল শ্যামল বাংলাদেশের বিশ্বস্ত প্রতিবিম্ব। তাঁর সৃজন-বৈভব এদেশের চিত্রকলার আন্দোলনে নবীন মাত্রা সঞ্চার করছে এবং নবীন প্রজন্ম তাঁর সৃজনধারায় অবগাহন করে শিকড়সন্ধানী হয়ে উঠছে।

বহু গুণান্বিত চিত্রকর কাইয়ুম চৌধুরী গ্রন্থের প্রচ্ছদ অংকন ও গ্রাফিক ডিজাইনেও সৃজন-উৎকর্ষে নিত্যনব উদ্ভাবনী কৌশলে পথিকৃৎ হয়ে আছেন। তিনি একক প্রচেষ্টায় এ দুটি মাধ্যমকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করেছেন।

সংগীতপিপাসু এই শিল্পীর সংস্কৃতির সব শাখায় সহজ বিচরণ ছিল। সাহিত্য, চলচ্চিত্র ও সংগীত নিয়ে তাঁর আগ্রহের অন্ত ছিল না। বিশেষত শাস্ত্রীয় সংগীতে তাঁর গভীর অনুরাগ ছিল। সংস্কৃতির নানা শাখা থেকে পরিগ্রহণ তাঁর সৃষ্টিকেও করে তুলেছিল গহন ও পরিশীলিতবোধে উজ্জ্বল।

তাঁর পটে তিনি বাংলাদেশের মানুষ, নদী ও নিসর্গের নানা অনুষঙ্গকে বহুরূপে ও বহুবর্ণে অংকন করেছেন। তাঁর সর্বশেষ প্রদর্শনীর শিরোনাম ছিল নকশিকাঁথার মধ্যে ভ্রমণ। এই নামকরণ থেকেই অন্বিষ্ট আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

যে কোনো জাতীয় সংকট ও দুর্যোগে তাঁর শিল্পসত্তা প্রবলভাবে আলোড়িত হয়েছে। তারই প্রতিফলন দেখা যায় তাঁর সৃষ্টিগুচ্ছে। বিশেষত মুক্তিযুদ্ধকে ভিত্তি করে তেলরং ও জলরঙে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন তিনি। 'অগ্নিদগ্ধ গ্রাম' সিরিজের যে ছবি অংকন করেছেন তিনি, শিল্পমূল্যে তা অসামান্য বলে বিবেচিত। মুদ্রণশিল্প ও প্রচ্ছদে তাঁর উদ্ভাবন তাঁকে এ ক্ষেত্রে শীর্ষ শিল্পীতে পরিণত করেছিল।

ভাবতে ভালো লাগে যে, কাইয়ুম চৌধুরী জীবনের অন্তিম মুহূর্তে যে কথাগুলো উচ্চারণ করেছিলেন তাতে যেমন তাঁর শিল্পরুচি, সংগীতরুচি, চারু ও কারুকলা অনুষদের শিক্ষাদর্শের কথা ছিল; তেমনি তিনি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছিলেন আচার্য জয়নুল আবেদিনের শিল্পরুচিকে। জয়নুল এই অনুষদের শিক্ষার্থীদের শুধু চিত্রবিদ্যাচর্চায় নিয়োজিতই রাখতে চাননি। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ও আদর্শের মধ্যে স্থান অধিকার করেছিল সংস্কৃতির সব শাখা থেকে শিক্ষার্থীরা রস ও রূপ গ্রহণ এবং নিজেদের সৃজন ও উদ্ভাবনী শক্তিকে দীপিত করুক। কাইয়ুম জীবনের অন্তিম বক্তব্যে এ কথাগুলো তাঁর মতো করে উচ্চারণ করেছিলেন।

কাইয়ুম চৌধুরী আচার্য জয়নুলের এই আদর্শকে ধারণ করেই তাঁর সাহিত্যবোধ, সংস্কৃতিবোধ ও সংগীতরুচিকে ছাত্রাবস্থা থেকেই লালন করেছেন এবং এভাবেই তাঁর সৃজনে এই বোধকে খুবই পরিশীলিতভাবে সমাজজীবনে ছড়িয়ে দিয়েছেন।

তাঁর আকস্মিক মৃত্যু আমাদের শুধু বিমূঢ় ও বিস্ময়াভিভূত করেনি; যে মানুষটি আজীবন সংগীতের নানাদিক-দিগন্ত নিয়ে রীতিমতো গবেষকের নিষ্ঠায় রুচিস্নিগ্ধ উচ্চ সংগীতকে ভালোবেসেছেন, তাঁর মৃত্যু হলো হাজার হাজার সংগীতপিপাসুর মধ্যে, সংগীতের উৎসবে। এ শুধু গৌরব ও সম্মানের নয়। কেননা, আমার কাছে কেবলই মনে হয়, এ বহু পুণ্যের এবং জনগণের কল্যাণ সাধনায় তাঁর জীবনে নানা কর্ম ও অর্জনের ফল।

কাইয়ুম শুধু স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত চিত্রশিল্পী ছিলেন না। তাঁর পট কত না সাধনা ও চর্চায় হয়ে উঠেছিল স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল ও মৌলিকত্বে বিশিষ্ট! বাংলা ও বাঙালির জীবনের বহুদিক ও নানা অনুষঙ্গ তাঁর পটে মর্যাদার সঙ্গে প্রতিবিম্বিত হয়েছিল। সংস্কৃতির সব শাখায় তাঁর সহজ-স্বচ্ছন্দ বিচরণ ছিল। চলচ্চিত্র, সাহিত্য, লোকশিল্প নিয়ে তাঁর আগ্রহ ও অনুরাগ তাঁর জীবন ও শিল্পবোধের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে মিশে গিয়েছিল। তাঁর পঠন-পাঠনের ঈর্ষণীয় ব্যাপ্তি ও ঐতিহ্যজিজ্ঞাসা আমাদের বিস্মিত করত।

সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থ সে বাংলা বা ইংরেজি যে ভাষায়ই হোক না কেন, সে সম্পর্কে খবর রাখতেন এবং সংগ্রহ করার জন্য আকুল হতেন। এভাবেই বইয়ের এক বিশাল সংগ্রহ তাঁর গড়ে উঠেছিল। তাঁর সংগ্রহে বিরল স্মৃতিকথা আছে। শিল্প ও সাহিত্য অঙ্গনের নানা ব্যক্তি, সমাজকর্মী, সাহিত্যিক, নারী ও চিত্রশিল্পীর। বিশেষত বিগত শতাব্দীর প্রথমার্ধ থেকে পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত বাঙালি সমাজ যে আবেগ, শিক্ষাদর্শ, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পরিবেশে বিকশিত হয়েছে ও তাদের মানস গঠনে ছাপ ফেলেছে, তা নিয়ে কাইয়ুমের আগ্রহের অন্ত ছিল না। এ সংক্রান্ত স্মৃতিকথা ও বিশ্নেষণাত্মক গ্রন্থ তিনি গবেষকের তৃষ্ণা নিয়ে সংগ্রহ করেছেন। বৈচিত্র্য ও মৌলিকত্বের এসব গ্রন্থ পাঠ তাঁর শিল্পতৃষ্ণা ও সৃজনেও যে ছাপ ফেলেনি, তা নয়।

পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র অঙ্গনে নবতরঙ্গ ও নয়া বাস্তববাদী চলচ্চিত্র এবং ভারতবর্ষে যেসব বিনোদনমূলক, নির্মল ও ধ্রুপদি সিনেমা মানুষের রুচি, মানবিকতা ও শিল্পবোধকে উন্নত করেছিল; কাইয়ুম প্রায়শ সে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতেন। তার স্মৃতিশক্তি ছিল অসাধারণ। কোন ছবিতে কে মনোগ্রাহী অভিনয় করেছেন, কে তার পরিচালক, কোন সিনেমার আবহ সংগীত অর্থময় ও ব্যঞ্জনাময়, কোন অভিনেতা বা অভিনেত্রীর অভিনয়শৈলী হৃদয়গ্রাহী, তা নির্ভুলভাবে বর্ণনা করতেন। এমনকি সেকালের ভুবনখ্যাত ও বিলোড়ন সৃষ্টিকারী জাজ সংগীতের অনুরাগী ছিলেন তিনি।

বর্ণবৈষম্য তখন তুঙ্গে। কালো মানুষেরা মার খাচ্ছেন যত্রতত্র। সংগীতের ভেতর দিয়ে কালো মানুষের স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা, স্বাধীনতার চেতনা ও মানবাধিকার নতুন মাত্রা পেয়েছিল। কালো মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এই সংগীত যে জাগরণের বীজ বপন করেছিল, কাইয়ুম সে কথা প্রায়ই বলতেন।

এ ছাড়া ভারতীয় ও পাশ্চাত্য সংগীতের এমন সমঝদার শ্রোতা আমি খুব কম দেখেছি। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের নানা ঘরানা, বিশিষ্টতা ও মৌলিকত্ব সম্পর্কে তাঁর গভীর জ্ঞান ছিল। পুরোনো গান, তিরিশ ও চল্লিশের দশকের রবীন্দ্র-গানের শিল্পীদের কণ্ঠনিঃসৃত সংগীতও তাঁর খুব প্রিয় ছিল। রাজেশ্বরী দত্ত, সাহানী দেবী, অমিয়া ঠাকুর, মালতী ঘোষাল, কনক বিশ্বাস, অমিতা সেনের (খুকু) গান নিয়ে তিনি প্রায়ই কথা বলতেন এবং দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শৈলজারঞ্জন মজুমদারের গানের শিক্ষায় শিক্ষিত যাঁরা, তাঁদের কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের গান হয়ে উঠেছিল সুর ও বাণীর সমন্বয়ে সত্যিকারভাবেই ভাবময়। তাঁর এমত ধারণা জন্মেছিল যে, রবীন্দ্রনাথের গানের শুদ্ধতা এই দুই শিক্ষকের শিক্ষায় দীক্ষিতদের কণ্ঠেই সত্যিকারভাবে, অর্থে ও ব্যাপ্তিতে উজ্জ্বলতা পেয়েছিল।

শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর চিত্রকলা বা সৃজনের একটি প্রধান অংশজুড়ে আছে লোকঐতিহ্যের ভাবনা। বাংলার লোকঐতিহ্যকে তিনি একজন বৃহৎ চিত্রকরের মতো পুনর্নির্মাণ ও আধুনিক শৈলীতে রূপায়িত করেছেন। এ রূপায়ণে তিনি ছিলেন আন্তরিক। কতভাবে যে তাঁর হাতে ঐতিহ্যভাবনা ও জিজ্ঞাসা পুনর্নির্মিত হয়েছে; বলে শেষ করা যায় না। এখানেই তিনি মৌলিকত্বের পরিচয় দিয়েছেন ও স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছেন। জীবনের অন্তিম দিনগুলোতে তাঁর ভাবনা ও সৃজনের সঙ্গে মিশে ছিল বাংলাদেশের গ্রামীণ মানুষের শৈল্পিক রূপায়ণে কাঁথা যে নান্দনিকতা এবং বহু ভাবনায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তার রূপায়ণ। ঐতিহ্যবাহী সূক্ষ্ণ সুচিকর্মের এই কাঁথার বহু মোটিফ তাঁর সৃষ্টিতে পুনর্নির্মিত হয়েছে। এই রূপায়ণ ছিল আধুনিক বোধ, বুদ্ধি ও মননে উজ্জ্বল।

বেঙ্গল আয়োজিত সর্বশেষ একক প্রদর্শনীতে অ্যাক্রিলিকে করা বেশ কয়েকটি কাজের শিরোনাম 'কাঁথার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি'। কয়েকটি ক্যানভাস ছিল বিশাল আকৃতির। কাঁথার মোটিফকে কত না জ্ঞান, প্রেম ও পরিপ্রেক্ষিত জ্ঞানে তিনি পটে উপস্থিত করেছিলেন! ভারতীয় ও পাশ্চাত্যের শাস্ত্রীয় সংগীত, রবীন্দ্রসংগীত, পঞ্চকবির গান ও আধুনিক গান তিনি প্রায়শ শ্রবণ করতেন। এই শ্রবণতৃষ্ণা থেকেই তাঁর গানের এক বিশাল ভাণ্ডার গড়ে উঠেছিল। আমাদের সাংস্কৃতিক ভুবনে রুচির এই সমগ্রতা খুবই বিরল। কাইয়ুম এ বিরল গুণের অধিকারী ছিলেন। চিত্রকলা সৃজনের সঙ্গে কোথায় যেন নিবিড় যোগ আছে শাস্ত্রীয় সংগীতের। বিংশ শতাব্দীর অনন্য এক ভাস্কর রামকিঙ্কর বেইজ এ রকম কথা বলেছিলেন। কাইয়ুম চৌধুরীর সৃজনের যে পরিশীলিত গুণ ও বোধ লক্ষ্য করি, তাতে এ কথার সত্যতা পরিস্টম্ফুট হয়ে ওঠে।

লোকশিল্পের প্রতি কাইয়ুম চৌধুরীর এই শ্রদ্ধা হয়ে উঠেছিল ঐতিহ্যভাবনার উজ্জ্বল প্রকাশ। এর সঙ্গে তাঁর চিত্রপটে মানুষের মর্মযাতনা এবং বেদনাও গুঞ্জরিত হয়েছে। এই বোধ, বুদ্ধি, শৈলীর বিশিষ্টতা ও মননের প্রাখর্য তিনি অর্জন করেছিলেন ব্যাপক পঠন-পাঠনের মধ্য দিয়ে। এই মৌলিকত্বই তাঁকে সমকালের একজন শ্রেষ্ঠ শিল্পীতে পরিণত করেছিল।

যদিও মৃত্যুর পর তাঁর ঐতিহ্যভাবনা ও লোকশিল্পের নানা মোটিফ কীভাবে তাঁর চিত্রপটে পুনর্নির্মিত হয়েছে, এ-প্রসঙ্গে আলোচনা হচ্ছে। আমি অবশ্য মনে করি, শুধু লোকঐতিহ্যের আধুনিকীকরণ কাইয়ুম চৌধুরীর একমাত্র লক্ষ্য ছিল না। এ বিষয়কে নিয়ে নানাভাবে ভেবেছেন ও পটে নানাভাবে তা উপস্থাপন করেছেন বটে, কিন্তু আসলে তিনি ছিলেন বাংলা ও বাঙালির দুঃখ ও কষ্টের এবং মনন-সৌকর্য উন্নয়নের রূপকার। তাঁর চিত্রপটে বা সৃজনে মানুষের মর্মযাতনা হয়ে উঠেছিল মৌল বিষয়। তাঁর বিভিন্ন পর্যায়ের বিভিন্ন সিরিজকে নানা দৃষ্টিকোণে যদি পর্যালোচনা করি, আমরা দেখব মানুষই হয়ে উঠেছিল প্রধান বিষয়। এমনকি মানবতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, কানসাট কিংবা টর্নেডোও উপেক্ষণীয় ছিল না।

অন্যদিকে বাংলাদেশের নদী, নিসর্গ ও মানুষের নিত্যদিনের জীবনসংগ্রাম নবীন মাত্রা নিয়ে তাঁর পটে উন্মোচিত হয়েছে। তাঁর ঈর্ষণীয় ড্রইংয়ে যে শৈলী ও দক্ষতা, শিল্পগুণের জন্য তা হয়ে ওঠে বিভাময় ও গহন। যে কোনো বিষয়ের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য খুব সামান্য রেখায় ফুটিয়ে তুলতেন তিনি।

কাইয়ুম চৌধুরীর রেখাও তাঁর পূর্বসূরির মতো সাবলীল। তাঁর রেখাও বৈচিত্র্যসন্ধানী। এই ভুবনে কখনো দেখা যায় রমণী-মুখ, নিসর্গ ও নদী। কখনো শৈশবস্মৃতি। এক্ষেত্রে তিনি জয়নুল-কামরুলের যোগ্য উত্তরসূরি।

বইয়ের প্রচ্ছদ ও অলংকরণ অংকনে শিল্পসুষমা ও শিল্পকৃতির যে ছাপ রেখেছেন, সেখানে তিনি একক। এদেশের বইয়ের প্রচ্ছদ, সচিত্রকরণ ও মুদ্রণশিল্পকে তিনি লব্ধ জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও নিত্যনতুন উদ্ভাবনীগুণে আধুনিক ও বৈশ্বিক মানের এক উচ্চতর পর্যায়ে উন্নীত করেছেন।

প্রকাশের স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে তাঁর সৃষ্টি ও চিত্রকলা। তেল ও জলরঙে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। এছাড়া ষাটের দশকে তিনি লিথো করেছেন। কিছুদিন আগে করেছেন বেশ কয়েকটি তাম্রতক্ষণ। প্রতিটি মাধ্যমের কাজে তাঁর শিল্পিত শৈলী যে গহনতাসন্ধানী; তা পরিস্টম্ফুট হয়েছে। এদেশের চিত্রকলা আন্দোলনে এই বহু ধারার কাজের মধ্য দিয়ে হয়ে উঠেছিলেন দেশের শীর্ষ শিল্পী।

কাইয়ুম চৌধুরী সাংস্কৃতিক অঙ্গনের নানা ক্ষেত্রে অবদান রেখে গেছেন। ষাটের দশকে স্বরূপচেতনা ও বাঙালিত্বের সাধনার যে আন্দোলন, তাতে তিনি সক্রিয়ভাবে, বিশেষ করে প্রগতিশীল ছাত্রসমাজের সাংস্কৃতিক কর্মে আন্তরিকভাবে সহায়তা করেছেন।

মুক্তিযুদ্ধে এদেশের তরুণ ও সাধারণ মানুষ যে সাহস ও শৌর্য নিয়ে সংগ্রাম করেছে, তা তাঁর চিত্রপটে মর্যাদা নিয়ে উঠে এসেছে। কাইয়ুম চৌধুরী-অংকিত মুক্তিযোদ্ধা বৈশিষ্ট্য ও শৈলীতে স্মরণীয়তার মূল্য পেয়েছে। তাঁর সৃজন ও জীবনাদর্শ এবং সমাজের জন্য অঙ্গীকার আমাদের যুগ যুগ ধরে প্রাণিত করবে। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর ভাবনা ও সৃষ্টির মধ্য দিয়ে।

প্রসঙ্গত, একটি বিষয় পরিশেষে বলতে চাই। কাইয়ুম চৌধুরীর সঙ্গে ষাটের দশকের মধ্য পর্যায় থেকে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কর্মের সূত্রে আমাদের সখ্যের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তখন তাঁকে দেখেছি মঞ্চ-লাজুক; বক্তৃতা-বিবৃতি থেকে তিনি দূরে থাকতে আগ্রহী। এমনকি ভ্রমণেও কোনো আগ্রহ নেই। আত্মসমাহিত নিভৃতিই তাঁর স্বভাবধর্ম। সে মানুষটিই পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে এক অঙ্গীকারবদ্ধ শিল্পীতে পরিণত হলেন। বিশেষত পঁচাত্তর-উত্তর রাজনৈতিক সংকট তাঁকে করে তুলেছিল প্রখরভাবে জ্ঞানে ও রাজনৈতিকভাবে একজন দায়িত্ববান ও অঙ্গীকারবদ্ধ সচেতন শিল্পী। পঁচাত্তর-উত্তর রাজনৈতিক সংকট নিয়ে তাঁর ভাবনার অন্ত ছিল না। অভিজ্ঞতা ও সংকট মোচনের দায় তাঁকে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মে বলীয়ান করেছিল। গণতন্ত্র ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের সংকট মোচনে নানা কর্মে যুক্ত হয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন অগ্রণী এক ব্যক্তিত্ব এবং নবীনদের প্রেরণাদায়ক এক শিল্পী।

পাঠকের মন্তব্য Login Registration