বিধিলিপি মন : আদ্যনাথ ঘোষ

প্রতিনিধি | সমালোচনা

রবিবার ৩০ জুন ২০১৯|১৭:২৭:৩৪ মি.


মোহাম্মদ আব্দুর রউফ

আদ্যনাথ ঘোষ তরুণ কবি। পেশায় শিক্ষক, নেশায় লেখক। প্রায় এক দশক কবিতার সঙ্গে আছেন। সব সময় কবিতায় মনোভাব প্রকাশ করতে চান। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যাও কম নয়। প্রতি বছরই এক বা একাধিক কবিতার বই বেরিয়েছে। সর্বশেষ বিধিলিপি মন (২০১৯) বইটি পাঠকের হাতে এসেছে। এই গ্রন্থেও উদীয়মান কবির মনের আবেগ নানাভাবে, নানা রঙে, নানা ঢঙে প্রকাশ পেয়েছে। সময়, সমাজ, মানুষ, প্রকৃতি, প্রেমবিরহ, সুখদুঃখসহ যাপিত জীবনের বহুমাত্রিক অনুষঙ্গ কবিমনে আলোড়ন তৈরি করে। এগুলোই কাব্য-অবয়বে কবিতার পাতায় শৈল্পিকমূর্তি লাভ করে।
বিধিলিপি মন কবিতাগ্রন্থে কবিতার সংখ্যা পঁচাত্তরটি। প্রথম কবিতা ‘আকাশে ডানা মেলে’, সর্বশেষ কবিতা ‘একাকিত্ব’। এখানকার কবিতাগুলো পাঠে বোঝা যায় আদ্যনাথ ঘোষ মনের বৈচিত্র্যময় ভাবনা কবিতাছন্দে বাধতে চেষ্টা করেছেন। 

সমাজে শ্রেণিবিভাজন সুষ্পষ্ট। কেউ পাঁচতলায়, কেউ গাছতলায়; কেউ খেতে পায় না, কারো খেতে ইচ্ছে করে না। যাদের খেতে ইচ্ছে করে না তারা না-খেতে পাওয়া মানুষের কথা ভাবে না। বরং এ সব প্রান্তিক মানুষের শোষণে ফুলেফেঁপে ওঠে ওদের সম্পদের আয়তন, সীমা-পরিসীমা। আদ্যনাথ এই শোষক ও শোষিত মানুষের কথা কবিতায় তুলে আনতে চেয়েছেন। শোষিতের প্রতি ইতিবাচক মানবিক অনুভূতির প্রকাশ ঘটেছে; সেই সঙ্গে শোষককে জবাবদিহিতার পরিসরে আনবার কথা বলতে চেয়েছেন। এই প্রকৃতির কবিতাকে মাক্সবাদী ধারার কবিতা বলা হয়ে থাকে। আদ্যনাথের কবিতায় এর প্রভাব সুষ্পষ্ট। কবি আদ্যনাথ এই মানবিক ভাব-ভাবনাগুলো অনেকটা সহজ-সরল ভাষায় প্রকাশ করেছেন কবিতায়। দু’একটি কাব্যপঙক্তি নিম্নরূপ-

‘আমি সেই সব সর্বহারাদের কথা বলছি 
যাদের ঘর নেই, চুলা নেই, এমনকি খাবারের ব্যবস্থাও নেই।’ (মে দিবসের কবিতা) 

মানুষ মাত্রেই স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে। স্বপ্ন দেখার মধ্যেও সুখ আছে। আবার স্বপ্নভঙ্গে অনুরূপ দুঃখও আছে। আদ্যনাথও স্বপ্ন দেখেন কিন্তু স্বপ্নগুলো ঠাকুরমার গল্পের মতোই, বাস্তবে মেলা ভার, তার স্বপন ‘মহাশ্মশানের একমুঠো ছাই।’ (একাকিত্ব) ফলে নিঃসঙ্গতা, একাকিত্ব ও বিষণœতা কবিকে পেয়ে বসে। হয়তো কখনো কখনো কবি কান্নায় ভেসে যান, বাঁশির সুরেও তাকে বিষণ্নতায় পেয়ে বসে। গানের পাখিরা উড়ে যায়; দুঃখকষ্টগুলো শ্রাবণের বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে। ‘বিবাগী মন’ কবিতায় পাচ্ছি-

‘গভীর আঁধারের জ্বালাময়ী-দুঃসহ দুঃখমালা
 শ্রাবণের বৃষ্টি হয়ে 
ঝরছে অবিরত।’ 

কবির মধুময় কোনো এক সাধ ছিল, সেটি ভেঙ্গে গেছে; বয়ে বেড়াচ্ছেন অনলযন্ত্রণা। 

তবে এটি স্বাভাবিক যে, মানুষ মাত্রেই ভালো কিছুর জন্য প্রতীক্ষা করে। জীবনের সব ব্যথাবেদনা, জ্বালাযন্ত্রণা, দুঃখকষ্টের অবসান হবে, একদিন সত্য সত্যই সুখের সন্ধান মিলবে-এই আশা-প্রত্যাশাতেই মানুষ বেঁচে থাক। কবি আদ্যনাথের মধ্যেও সেই প্রত্যাশা সমানভাবেই বিরাজমান। এই কবিও অন্ধকার কেটে আলোর অভিমুখী; ইতিবাচক পরিবর্তন-প্রত্যাশায় প্রতীক্ষা করেন। ‘ভোরের প্রত্যাশায়’ কবিতায় এই রকম অভিব্যক্তি দেখতে পাচ্ছি। প্রাসঙ্গিক কাব্যরচণ-

কখন উঠবে গো ভোরের সূর্য
কখন কাটবে অন্ধকার
এ আশায় রাত জেগে
আঁধার পাড়ি দিতে থাকি
কূলের প্রত্যাশায়...  

সমকালীন সমাজ ও সমাজব্যবস্থাপনায় দুঃখমুক্ত থাকাটা বেশ কঠিন। তবু এত দুঃখের মধ্যেও কবি আদ্যনাথ ঘোষের কাব্যপরিসরে প্রেমভাবনা বলা যায় সমভাবেই উপস্থিত। শুধু প্রেমপ্রণয় নয়, বরং রীতিমত রোমান্স প্রকৃতির প্রণয়ভাবনা। তবে আদ্যনাথ প্রণয়ে সুখ পাচ্ছেন না, দুঃখই পাচ্ছেন, প্রেম তাকে প্রতারিত করছে, সব কিছু ভেঙেচুরে তছনছ করে দিয়ে যাচ্ছে। একারণে প্রেমকে তিনি সর্বনাশা ঝড়ের সঙ্গে তুলনা করেছেন; জীবনকে নিষ্ফলা মাঠ মনে হয়েছে। কবি বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পেরেছেন-

‘সবশেষে জানিলাম-
যে আমারে বেঁধেছিল 
 সে আমার নয়।’ (হতাশার ধোঁয়া)

যাই হোক, ভালোবাসা ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। যে কোনো অবস্থায়, যে কোনো বয়সেই মানুষ ভালোবাসার জন্য অপেক্ষা করে। আদ্যনাথের কবিতায় সেই প্রতীক্ষা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। ‘চৌষট্টিকলা’ কবিতায় কবির প্রতীক্ষার প্রহর গুনছেন এভাবে-

‘যদি আসো একবার আমার গৃহদ্বারে
লজ্জাহীনা মহান জোছনামাখা শর্বরী
একটি চুম্বন দিয়ে তোমাকে শেখাবো-
কামের চৌষট্টিকলা।’

বিন্দু বিন্দু সময়ের যোগফলে এই জীবন। জীবনও সময়ের হাত ধরাধরি করে এগিয়ে চলে। সামনের সময়গুলো স্বপ্নেভরা থাকে, আর ফেলে আসা দিনগুলো স্মৃতির পাতায় ভিড় করে। সেই স্মৃতি কমবেশি সবাইকে সময়ে-অসময়ে নাড়া দেয়। কবি আদ্যনাথ ঘোষের কবিতায় এই স্মৃতির প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। ফেলে আসা সময় ও জীবনযৌবন মাঝে মাঝেই উঁকি দিয়ে যায়। ‘ফেলে আসা দিনের স্মৃতি’ কবিতায় নস্টালজিয়া মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে এভাবে-

‘ফেলে আসা কৈশোরের সেই গলিপথটাকে
আছে সে কেমন? নাকি পাল্টে গেছে
ঠিক তোমার আমার মতো করে।’

সময় এগিয়ে যায়, মানুষ এগিয়ে যায়, কিছু স্মৃতি রয়ে যায়। এগুলো মানুষকে আলোড়িত করে। এ রকম কৈশোরের স্মৃতি ছাড়াও প্রেমবিরহ, পুরাণ-প্রণয়, প্রকৃতি, সুখদুঃখ, নিঃসঙ্গতা, একাকিত্ব ইত্যাকার নানামাত্রিক মানবিক অনুষঙ্গগুলো কবি আদ্যনাথের কবিতায় লক্ষ করা যায়। তার শব্দ নির্বাচন, বিষয়বিন্যাস ও উপস্থাপনে নিজস্বতা রয়েছে। বাংলা সাহিত্যাকাশে আদ্যনাথ ঘোষ বিচরণ করুক-এটি পাঠকের প্রত্যাশা।      
 

পাঠকের মন্তব্য Login Registration