নজরুল সাহিত্যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা

প্রতিনিধি | সাহিত্য

শনিবার ১৮ আগস্ট ২০১৮|১৭:৪১:১৫ মি.



সৈয়দ আল জাবের আহমেদ
    
বিশ শতকের বিস্ময়কর সাহিত্য প্রতিভা কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)। বাংলা সাহিত্যের যুগস্রষ্টা কবি নজরুল, যিনি বাংলা সাহিত্যের ধারাকে এক ভিন্ন ও নতুন দিকে প্রবাহিত করেছেন। তিনিই প্রথম সর্বমানবিক মানসের প্রয়াস, প্রয়োগ ও প্রকাশ ঘটিয়েছেন বাংলা সাহিত্যে। কাজী নজরুল ইসলামই তাঁর কবিতায়, গানে, গল্পে, উপন্যাসে, নাটকে, প্রবন্ধে, চিঠিপত্রে  ও অভিভাষণে সাধারণ মানুষের জয়গান গেয়েছেন, নিপুণ হাতে লিখেছেন তাদের দুঃখ-বেদনা ও হাহাকার। অসাধারণ ও অনন্য সে বয়ান ও বুনন। তাঁর সমগ্র সাহিত্য ও শিল্প কর্মের অন্তরালে যে অনুভূতি ও অভিপ্রায় নিহিত ছিল তা হলো অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও বিশ্বাস। বিশ বছরের সাহিত্য জীবনের প্রতি পৃষ্ঠায় কেবল এই চেতনারই অনুলিপি প্রতিফলিত হয়েছে। 
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৮) বিভীষিকাময় প্রতিবেশ, পাশবিক উল্লাস, গণহত্যার নির্মম উৎসব কবি নজরুলকে বিচলিত করে প্রবলভাবে। ভারতবর্ষের সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় দাঙ্গা, মানুষের প্রতি মানুষের বিদ্বেষ, বর্ণ-জাত জিঘাংসা, হিংসা, নিষ্ঠুরতা, অবজ্ঞা, অবহেলা ইত্যাদি অমানবিক আচরণ ও মানবিক বিপর্যয়ের করুণ দৃশ্য যা মূলত ঔপনিবেশিকতার ফসল তা নজরুল সাহিত্যের অসাম্প্রদায়িক চেতনা তৈরিতে প্রভাবকের ভূমিকা রেখেছে।
কাজী নজরুল ইসলামের আগে ও পরে সুস্পষ্টভাবে কোন সাহিত্যিক তাঁদের রচনায় অসাম্প্রদায়িক চেতনার কথা উচ্চারণ করেননি। প্রায় সকলের সাহিত্যকর্ম সাম্প্রদায়িকতায় আক্রান্ত। শুধু বাংলা নয় বিশ্ব সাহিত্যেও নজরুল এক বিরল সাহিত্য ব্যক্তিত্ব।
কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব পরাধীন ভারতবর্ষে। ভারত বহুধর্ম ও সংস্কৃতির দেশ। বিচিত্র ও বৈচিত্রের দেশের মানুষ বেঁচে থাকতে হলে প্রয়োজন পরমত ও পরধর্মসহিষ্ণু মনোভাবের যা তাঁর সমকালে ছিল অনুপস্থিত। তাই সামাজিক জীবনে ছিল না কোন সদ্ভাব ও সম্প্রীতি। ভারতবর্ষের দুই বৃহৎ সম্প্রদায় হিন্দু ও মুসলমান। এই দুই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে সুন্দর ও কল্যাণকর সম্পর্ক তৈরির জন্য সাহিত্য রচনা করেন নজরুল। বেছে নিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার পথ। অসাম্প্রদায়িক চেতনা মানে হলো কোন ধর্ম ও সম্প্রদায়ের প্রতি এবং সকল ধর্ম-সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি বিদ্বেষ মনোভাব না পোষণ করে মানবিক আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গির লালন করা। আজকাল অসাম্প্রদায়িক-সাম্প্রদায়িকতার নামে যে চেতনার কথা বলা হচ্ছে ও প্রচার চলছে তা মূলত ইসলামের প্রতি বিরূপ মনোভাব ও বাঙালিয়ানার মোড়কে অন্য ধর্মীয় আচার-আচারণের প্রভাব-প্রচারণার নামান্তর। কবি নজরুল ইসলাম মোটেই এরকম অসাম্প্রদায়িক চেতনার কথা বলেননি, লেখেননি, বিশ্বাসও করেননি। তাঁর সমগ্র সাহিত্য পাঠে এমনটি অনুভূত হয়।
আমরা নজরুল সাহিত্যে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বিষয়-আচার, রীতি-নীতি নিয়ে লেখা দেখতে পাই। কবি নজরুলের এমন মানস কীভাবে তৈরি হলো? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজলে আমরা জানতে পারি নজরুল শৈশবে-কৈশোরে মক্তবে পড়তেন ও পড়াতেন, মসজিদে ইমামতি করতেন যার মাধ্যমে তিনি ইসলাম ধর্মের মানবিক চেতনা ও বিশ্বাসের কথা জেনেছেন। ইসলাম ধর্ম থেকে শিখেছেন ‘লা ইকরাহা ফিদদ্বীন’ ধর্মে কোন জোর-জবরদস্তি নেই (সূরা বাকারা, আয়াত-২৫৬)। আরও জেনেছেন, “লাকুম দ্বীনুকুম ওয়ালিয়া দ্বীন”(সূরা কাফিরুন) । নজরুল কিশোর বয়সে লিখেছেন ‘লেটো’ দলের জন্য গান। পড়েছেন বিপুল পরিমাণে রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণ।
এ প্রসঙ্গে সুশীলকুমার গুপ্তের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য— ‘যেখানে কীর্তন হত, কথকতা হত, যাত্রাগান হত, মৌলবীর কোরান পাঠ ও ব্যাখ্যা হত, দুরন্ত বালক গভীর আগ্রহ ও মনোযোগের সঙ্গে সেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতেন। বাউল, সুফী, দরবেশ, সাধু-সন্ন্যাসীর সঙ্গে তিনি অন্তরঙ্গভাবে মিশতেন।’ (নজরুল চরিতমানস, ড. সুশীলকুমার গুপ্ত)।
এভাবেই অসাম্প্রদায়িক মানস ও চেতনার ধারক ও বাহক হলেন কবি নজরুল। শুধু সাহিত্যেই নয় তিনি তাঁর বাস্তব জীবনেও অসাম্প্রদায়িক চেতনার সাক্ষর রেখেছেন। বিয়ে করেছেন হিন্দু মেয়ে প্রমীলা দেবীকে। এ প্রসঙ্গে নজরুল বলেছেন,‘‘কারুর  কোনো ধর্মমত সম্বন্ধে আমার কোনো জোর নাই। ইচ্ছে করে তিনি মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করলে, পরেও করতে পারবেন।’ (যুগস্রষ্টা নজরুল, খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীন)
‘গাহি সাম্যের গান-
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়াান,
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি,
সব দেশে, সব কালে, ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি! (মানুষ, সাম্যবাদী)
বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ সাহিত্য উচ্চারণ। মানুষের জন্য, মানুষের পক্ষে, মানবতার সুউচ্চ ও উচ্চকিত মহান এ বাণী কেবল কবি নজরুলে পক্ষে উচ্চারণ করা সম্ভব হয়েছে। সমকালে কেউ করেনি এমন। মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসার প্রকাশ। একজন কবির কবি মানস কতটা মানব প্রেমের আকর হলে এমন সর্বমানবীয় অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাণী উচ্চারিত হতে পারে।
তাঁর ‘সাম্যবাদী’ কবিতায় দেখি আরেক সাহসিকতার পরিচয়, তিনি লিখেছেন, 
‘গাহি সাম্যের গান—
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান,
যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান।’ (সাম্যবাদী)
কী অসাধারণ মমতায় লিখেছেন কবি নজরুল। সব মানষের মানবিক পরিচয়ে বন্ধন কামনা করে ব্যবধান ঘুচাতে চেয়েছেন। এখানে কোন ধর্মের প্রতি নেই কোন বিরূপ মনোভাব ও বিদ্বেষ। কোন ধর্মের প্রতি নেই কোন বিরোধ। ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা ও বিশ^াস রেখে সব ধর্মের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতিই কামনা করেছেন নজরুল। ধর্মের নামে অধর্মের বিনাশই চেয়েছেন তিনি। অধর্ম কোন কালেই ধর্মের সৃষ্টি নয় তা কায়েমী স্বার্থবাদীদের তৈরি করা মনগড়া নিয়ম। নজরুল সে সবের মূলে আঘাত করেছেন। 
তিনি লিখেছেন,
‘জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াৎ খেলছে জুয়া
ছুঁলেই তোর জাত যাবে? জাত ছেলের হাতের নয়কো মোয়া।।
হুঁকোর জল আর ভাতের হাঁড়ি ভাব্লি এতেই জাতির জান,
তাইত বেকুব, করলি তোরা এক জাতিকে একশ’-খান।
এখন দেখিস ভারত জোড়া পঁচে আছিস বাসি মড়া,
মানুষ নাই আজ, আছে শুধু জাত-শেয়ালের হুক্কাহুয়া।’ (জাতের বজ্জাতি, বিষের বাঁশি)
জাত দিয়ে মানুষের বিচারের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন কবি নজরুল। বর্ণ-জাত কোনভাবেই স্রষ্টার সান্নিধ্য পাওয়ার উপায় হতে পারে না। এগুলো অধর্ম, এসব সমাজসৃষ্ট কুসংস্কার। কাজী নজরুল ইসলাম এখানে মনুষ্যত্ব বিবর্জিত এই সাম্প্রদায়িক মনোভাবের, ভেদ-বুদ্ধির মূলে কুঠারাঘাত করে মানুষের জয়গান গেয়েছেন।
কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম কাব্যের নাম ‘অগ্নি-বীণা’। এটি প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালে। এ কাব্যে মোট ১২টি কবিতা রয়েছে। এই কাব্যে যেমন আছে ইসলামি ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বয়ান, তেমনি আছে হিন্দু ধর্মের পুরাণ-পার্বণের কথা। এমন সমাহার বাংলা সাহিত্যে আর নেই। এরকম অসাম্প্রদায়িক চেতনা সমৃদ্ধ কাব্য দ্বিতীয়টিও নেই।
কবি নজরুল তাঁর ‘পুতুলের বিয়ে’ নাটকে  যা তাঁর ‘সুর-সাকী’তেও আছে তাতে  লিখেছেন—
‘মোরা এক বৃন্তে দু’টি কুসুম (ফুল) হিন্দু-মুসলমান।
মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ।।
এক সে আকাশ মায়ের কোলে  
যেন রবি শশী দোলে,
এক রক্ত বুকের তলে, এক সে নাড়ির টান।।
এক সে দেশের খাই গো হাওয়া, এক সে দেশের জল,
এক সে মায়ের বক্ষে ফলাই একই ফুল ও ফল।
এক সে দেশের মাটিতে পাই 
কেউ গোরে কেউ শ্মাশানে ঠাঁই
এক ভাষাতে মা’কে ডাকি, এক সুরে গাই গান।।’
এই গানে নজরুল তাঁর অনন্য অসাম্প্রদায়িক মানসিকতার উন্মেষ ঘটিয়েছেন। একই দেশে বাস, একই পানি পান করি, একই হাওয়া নিই, আবার একই মাটিতে আমাদের ঠাঁই, এরপর কেন বিভেদ থাকবে আমাদের মাঝে! একই আকাশের নিচে হার্দিক সম্পর্কে মিলেমিশে থাকবো সবাই, এই বাসনাই করেছেন নজরুল।
কাজী নজরুল ইসলাম দু’হাত ভরে লিখেছেন হিন্দু-মুসলমানের জন্য গান-গজল, হামদ-না’ত, কীর্তন-শ্যামাসঙ্গীত। তিনি সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দেননি। মনে ও মননে পোষণ করেননি ধর্মের কারণে বিদ্বেষ ও রিরংসা, দেননি কোন সংর্কীণতার পরিচয়।
লিখেছেন—
‘আমার কালো মেয়ের পায়ের নীচে
দেখে যা আলোর নাচন
মায়ের রূপ দেখে দেয় বুক পেতে শিব
যার হাতে মরণ বাঁচন 
আমার কালো মেয়ের আঁধার কোলে
শিশু রবি শশী দোলে
মায়ের একটুখানি রূপের ঝলক
ঐ স্নিগ্ধ বিরাট নীল গগন ’ (বনগীতি)
আবার তিনিই লিখেছেন—
তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে।
মধু পূর্ণিমারই সেথা চাঁদ দোলে।
যেন ঊষার কোলে রাঙ্গা রবি দোলে (জুলফিকার)
এমন উদার অসাম্প্রদায়িক সাম্যবোধ ও চেতনার দৃষ্টান্ত বিরল বাংলা সাহিত্যে। নজরুল সাহিত্যের পরতে পরতে এমন উদাহরণ ছড়িয়ে আছে। তাঁর সাহিত্যকর্মের প্রকৃত সুরই হলো অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও বিশ্বাস। কবি নিজের সাহিত্যের উদ্দেশ্য সম্পর্কে নিজেই তাঁর বিখ্যাত অভিভাষণে বলেছেন—
‘কেউ  বলেন, আমার বাণী যবন, কেউ বলেন, কাফের। আমি বলি ও দুটোর কিছুই নয়। আমি মাত্র হিন্দু-মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করাবার চেষ্টা করেছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি’ 
এ থেকেই অনায়াসে বুঝা যায়, কবি নজরুলের সাহিত্য চেতনা। বাংলা সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলামই একমাত্র স্পষ্ট ও অকপট অসাম্প্রদায়িক চেতনার দিকপাল।


 

পাঠকের মন্তব্য Login Registration