আবৃত্তি সম্রাট কাজী সব্যসাচী ইসলাম

প্রতিনিধি | সমালোচনা

শনিবার ৪ আগস্ট ২০১৮|১৮:৫২:৩৯ মি.



সৈয়দ আল জাবের 

আবৃত্তি মুগ্ধমধুর শিল্প। শ্রুতিমুগ্ধ শরদিন্দুসম নান্দনিক প্রায়োগিক শিল্প। কবিতা যদি চাঁদ হয় তাহলে আবৃত্তি চাঁদের জোছনা। কবিতা ও আবৃত্তি মানুষের মন ও মনন ছুঁয়ে যায়, স্পর্শ করে। বোধের উন্মেষ ঘটায়, উত্তেজিত করে আবেগ, বিনোদিত হয় চিত্ত, উদ্বেলিত হয় হৃদয়। প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকেই কবিতা স্বীকৃত ও মৌলিক শিল্প হলেও আবৃত্তি আধুনিককালে শিল্প হয়ে উঠেছে। স্বীকৃতি লাভ করেছে সুধীজন এবং সাধারণ মানুষের কাছে। কবিতার আবৃত্তি যে একটি স্বতন্ত্র ও পৃথক প্রায়োগিক শিল্প হতে পারে-তার হাতেখড়ি হয় কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের চিন্তায়। তিনি আবৃত্তিকে মাথায় রেখে কবিতা রচনা করতেন। এভাবেই শুরু হয় আবৃত্তি শিল্পের আধুনিকতার যাত্রা। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়েও একই ধারা চলে, তবে তা ছিল সীমিত পর্যায়ে। রবীন্দ্রযুগেই শিশির কুমার ভাদুড়ী, নির্মলেন্দু লাহিড়ী প্রমুখ থিয়েটারের পাশাপাশি শখের বশে টুকটাক আবৃত্তি করতেন। এঁদের পরে শম্ভু মিত্র আবৃত্তিকে শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠার চিন্তা থেকে উচ্চারণ ও প্রয়োগ প্রক্রিয়ার সূচনা করেন। পাশাপাশি আবৃত্তিশিল্পকে জনসাধারণের কাছে জনপ্রিয় করার প্রয়াস চালান। কেননা তিনি ছিলেন মূলত মঞ্চাভিনেতা। এমন একটি সম্ভাবনাময় সময়ে দারাজ, গম্ভীর ও মিষ্টি কণ্ঠস্বর নিয়ে আর্বিভূত হন কাজী সব্যসাচী ইসলাম (১৯২৯-১৯৭৯)। আবৃত্তি যে আজ শ্রোতাপ্রিয় সার্থক শিল্প হিসেবে সমাদৃত তাঁর পথিকৃৎ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের তনয় কাজী সব্যসাচী ইসলাম। 
কাজী সব্যসাচী ইসলাম ১৯২৯ সালের ৯ই অক্টোবর কলকাতার ৮/১, পান বাগান লেনে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা বাংলা সাহিত্যে নবযুগ উম্মেষক কবি কাজী নজরুল ইসলাম, মা প্রমীলা দেবী। তাঁর ডাকনাম সানি। কাজী সব্যসাচীর স্ত্রী উমা কাজী। তাঁর তিন সন্তানÑখিলখিল কাজী, মিষ্টি কাজী ও বাবুল কাজী। কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘পুতুলের বিয়ে’ নাটকটি কাজী সব্যসাচী ওরফে সানিকে উৎসর্গ করেছিলেন। রেডিও স্টেশন ‘আকাশবাণী’ কলকাতায় অনুষ্ঠান ঘোষক পদে চাকরি করতেন তিনি। এই চাকরি ছেড়ে দিয়ে আবৃত্তি ও বাচিক শিল্পকে সার্বক্ষণিক পেশা হিসেবে বেছে নেন। আজকের এই দিনেও যা ভাবা যায় না! আবৃত্তিশিল্প একটি পেশা! বিস্ময়কর হলেও এটাই সত্য যে, কাজী সব্যসাচী এই দুঃসাহসিক কাজটি করেছিলেন। যার ফলে আজ আবৃত্তি শ্রোতাচিত্তহারী মনোমুগ্ধকর মার্জিত এক শিল্প। সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় তিনিই আবৃত্তি শিল্পকে পৌঁছে দিয়েছিলেন । আজ হাজার হাজার মানুষ সরাসরি এ শিল্পের সাথে যুক্ত। বিনোদনের অন্যতম অনুষঙ্গ হচ্ছে আবৃত্তি। বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ বিশে^র বিভিন্ন দেশে প্রায় প্রতিদিনই রেডিও, টেলিভিশনসহ বিভিন্ন মঞ্চে আবৃত্তি অনুষ্ঠান হচ্ছে এবং বিপুল দর্শক-শ্রোতা তা উপভোগ করছে। আজকে আবৃত্তি শিল্পের এই উন্নতি ও জনপ্রিয়তার পেছনের মহান কারিগর ছিলেন কাজী সব্যসাচী।  
আবৃত্তিশিল্পে কাজী সব্যসাচীর অবস্থান ও অবদান প্রসঙ্গে আবৃত্তিশিল্পী ও গবেষক দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘তারপর একালে আবৃত্তিকে ঘিরে অকস্মাৎ উদ্দামতার জোয়ার এলো; আর এই উদ্দামতার কেন্দ্রবিন্দুতে যাঁর অধিষ্ঠান তিনি হলেন কাজী সব্যসাচী। অনস্বীকার্য যে, সাধারণ মানুষের কাছে আবৃত্তিকে হৃদয়গ্রাহী ক’রে তোলার কৃতিত্বের সিংহভাগের দাবিদার কাজী সব্যসাচী এবং আবৃত্তি যে আজ পুরোপুরি পেশাদারী শিল্প হয়ে উঠেছে তারও পথপ্রদর্শক তিনিই। আগে আবৃত্তি ছিল নিতান্ত শৌখিন বা আধা-শৌখিন সংস্কৃতিচর্চা। বস্তুতপক্ষে, ১৯৬২ সালে আকাশবাণীর ঘোষকের চাকরি ছেড়ে দিয়ে সব্যসাচী যদি আবৃত্তিকে জীবিকার সঙ্গে একসূত্রে গেঁথে না নিতেন, তাহলে পেশাদারী প্রয়োগশিল্প হিসেবে আবৃত্তির বাড়বাড়ন্তের এই শুভদিন আসতে আরো কত-যে বিলম্ব হতো তা কে জানে! দীর্ঘ ঋজু বলিষ্ঠ চেহারায় প্রবল ব্যক্তিত্ব, মঞ্চাবতরণে জড়তাহীন স্বাচ্ছন্দ্য, সাবলীল পরিবেশনশৈলী, উদাত্ত, গম্ভীর, কণ্ঠস্বর, আকাশবাণীর ঘোষক হিসেবে অপ্রতিদ্বন্দ্বী জনপ্রিয়তা এবং বিদ্রোহী-কবি কাজী নজরুল ইসলামের পুত্রপরিচয়—এই সব কিছু মিলিয়ে সব্যসাচীর যে ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছিল তাতে তিনি অনায়াসে শ্রোতৃচিত্ত জয় করতে পেরেছিলেন এবং অচিরেই আবৃত্তিকার হিসেবে একচ্ছত্র প্রতিষ্ঠা ও রাজ্য-জোড়া খ্যাতির অধিকারী হয়েছিলেন। কাজী সব্যসাচীর তড়িৎ সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে হুবহু তাঁরই অনুকারী কয়েকজন তরুণ আবৃত্তি আসরে নেমে পড়লেন; তাঁদের ঘিরে ভক্ত ও অনুরাগীর সংখ্যাও দেখতে দেখতে স্ফীত হয়ে উঠলো।’ তিনি আরো লিখেছেন, ‘একথা ঠিক যে, সাধারণ শ্রোতার কাছে আবৃত্তিকে প্রিয় ক’রে তোলায় কাজী সব্যসাচীর ভূমিকা অতুলনীয়।’ (বিষয়: আবৃত্তি, সম্পাদনা দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ও অমিয় চট্টোপাধ্যায়, পৃষ্ঠা: গ-ঘ, দে’জ পাবলিশিং, অক্টোবর ২০১৫, কলকাতা)। 
প্রখ্যাত শিল্পী সন্তোষ সেনগুপ্ত কাজী সব্যসাচী সম্পর্কে বলেন, ‘আবৃত্তি জগতে কাজী সব্যসাচীর অপরূপ কণ্ঠসম্পদ, সুস্পষ্ট উচ্চারণ ভঙ্গী, অসাধারণ মঞ্চ ব্যক্তিত্ব। সব মিলিয়ে তাঁর মতো কাউকে দেখিনি। সব্যসাচীই প্রথম আবৃত্তির দ্বার-উদঘাটন করলেন।’ (অন্তরঙ্গ আলোকে নজরুল ও প্রমীলা, আসাদুল হক, পৃষ্ঠা: ৯৪, শোভা প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০০৯, ঢাকা।)
কাজী সব্যসাচী ইসলামের কণ্ঠ বিরল, অনুপম, সুষমামন্ডিত। তাঁর আবৃত্তি মহুয়া মাদকতায় পরিপূর্ণ। তিনি ছিলেন অনুরণিত, নমনীয়, স¦চ্ছ-সাবলীল, ত্রুটিহীন, ভরাট ও উদাত্ত স্বরের অধিকারী এবং স্বর-সুরের মিষ্টিমধুর জলধারা। আজও তিনি অপ্রতিদ্বন্দী, অতুলনীয়। এখনও কেউ স্পর্শ ও অতিক্রম করতে পারেনি তাঁর জনপ্রিয়তার চূড়া।
‘আবৃত্তিকলা’ গ্রন্থে খসরু চৌধুরী তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন, ‘কাজী সব্যসাচীই সম্ভবত বাংলা আবৃত্তিতে আধুনিক ধারার প্রবর্তন করেন। অন্য কেউ যদি করেও থাকেন, শ্রেষ্ঠ অনুষ্ঠাতা হিসেবে সব্যসাচীর অবদানই সর্বাগ্রগণ্য। আধুনিক ধারা অর্থে বোঝানো হচ্ছে থিয়েট্রিক্যাল ধারার বিপরীতে ব্রডকাস্টিং ধাঁচের ধারার প্রবর্তন। অঙ্গভঙ্গি একেবারে পরিহার করে শুধুই স্বরনির্ভরতা। তিনিই প্রথম নিখাঁদ পেশাদার আবৃত্তিকার। নাটক বা অন্যান্য মাধ্যমে বিকশিত হবার প্রলোভন ত্যাগ করে, এমনভাবে আবৃত্তিকে আঁকড়িয়ে ধরেছেন যে, বাংলা আবৃত্তিকে মধ্যবিত্তের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়ে ছেড়েছেন। কাজী সব্যসাচী বাংলাভাষার প্রথম জনপ্রিয় আবৃত্তিকার। জনপ্রিয়তায় তাঁর স্থান আজও সবার শীর্ষে। সব্যসাচীর আগে আবৃত্তিকে বিনোদন মাধ্যম হিসেবে প্রচারের চেষ্টা কেউ চালাননি। জীবদ্দশাতেই সেই প্রচারের ফল তিনি পেয়েছেন। আবৃত্তি শুনতে আমাদের বাধ্য করেছেন। সবচেয়ে বড় কথা, তিনি আমাদের আনন্দ দিয়ে গেছেন।’ (আবৃত্তিকলা, খসরু চৌধুরী, পৃষ্ঠা ১৪৬-৪৭, বিদ্যাপ্রকাশ, জুলাই ১৯৮৯, ঢাকা)।
আবৃত্তিশিল্পী, আবৃত্তি গবেষক ও লেখক নাসিম আহমেদ, কাজী সব্যসাচী ইসলাম প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘ষাটের দশকে কাজী সব্যসাচী আবৃত্তিকে স্বতন্ত্র শিল্পমাধ্যম রূপে গণ্য করে আবৃত্তি চর্চা শুরু করেন। বলতে গেলে তাঁর হাত দিয়েই আধুনিক বাংলা আবৃত্তি শিল্পের চর্চা শুরু হয়’। কাজী সব্যসাচী আবৃত্তিকে স্বতন্ত্র শিল্পমাধ্যম রূপে প্রতিষ্ঠিত করেন। কাজী সব্যসাচীর আবৃত্তির মধ্যে দিয়ে আরো একটি সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে যে, আবৃত্তির জন্য শুধু কবিতা নয় সাহিত্যের সকল কিছুই আবৃত্তিযোগ্য হতে পারে। সব্যসাচীর প্রখর সঙ্গীতময় প্রাণখোলা আবৃত্তি গণমানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়েছে। আবৃত্তিকে তিনি ড্রয়িংরুম চর্চা বা ব্যক্তিগত সখের চর্চার সীমানা ছাড়িয়ে একেবারে খোলামেলা স্বরের আসরের বিষয়, জনসভার ব্যাপার করে তুলেছেন। একসঙ্গে অযুত মানুষের শোনবার শিল্পে পরিণত হয়েছে আবৃত্তি। আর সেই সঙ্গে আবৃত্তি পাশর্^চর্চার অমর্যাদাকর অবস্থান থেকে মুক্তি পেয়ে একেবারে স্বতন্ত্র ও স্বয়ংসম্পূর্ণ শিল্প হিসেবে নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। তাঁর স্টাইলকে আধুনিক বলা যায়, কারণ, তাঁর আবেগের প্রকাশে বাড়াবাড়ি নেই এবং সংহত, পরিমিত। তিনি প্রচলিত প্রাচীন নাটুকে ধারার আবৃত্তির বিপরীতে ব্রডকাস্টিং ধাঁচের আবৃত্তির প্রবর্তক। তিনি আবৃত্তিতে অঙ্গভঙ্গি পরিহার করে কণ্ঠ নির্ভর শিল্পে পরিণত করেন। এসব তাঁর কৃতিত্ব।’ (নজরুল-আবৃত্তি প্রসঙ্গ, নাসিম আহমেদ, পৃষ্ঠা ৪৬-৪৯, নজরুল ইন্সটিটিউট, এপ্রিল ২০০১, ঢাকা)।
উপর্যুক্ত গুণী ও প্রাজ্ঞজনদের স্বীকৃতি, মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা এ কথা অনায়াসে অবলীলায় বলতে পারি যে, কাজী সব্যসাচী ইসলামই আধুনিক বাংলা আবৃত্তি শিল্পের পথিকৃৎ, প্রবর্তক ও প্রতিষ্ঠাতা। বাংলা আবৃত্তি শিল্পের ইতিহাসের অবিস্মরণীয় নাম কাজী সব্যসাচী ইসলাম। আমাদের দেশে ও ভারতের পশ্চিম বঙ্গসহ পৃথিবীর যে প্রান্তেই বাংলাভাষী মানুষ আছেন ও আবৃত্তি চর্চা করে থাকেন তাদের সকলেরই উচিৎ কাজী সব্যসাচীকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণে রাখা, মননে মরমে গেঁথে নেয়া, তাঁকে চর্চা করা, তাঁর উপর গবেষণা করা। কাজী সব্যসাচী ইসলামের স্মৃতি সংরক্ষণের জাতীয় উদ্যোগ ও পদক্ষেপ গ্রহণ করা অপরিহার্য ও সময়ের দাবি। কাজী সব্যসাচী ইসলামের মৃত্যু অথবা জন্ম তারিখকে আবৃত্তি শিল্প দিবস ঘোষণা ও স্বীকৃতি দিয়ে তাঁকে স্মরণ এবং আবৃত্তি শিল্পের নান্দনিক চর্চাকে আরও গতিশীল ও বেগবান করা। আর দ্বিধাহীন চিত্তে এ স্বীকৃতি ও অভিধা দেওয়া যে, আধুনিক বাংলা আবৃত্তি শিল্পের পথিকৃৎ আবৃত্তি সম্রাট কাজী সব্যসাচী ইসলাম।
আবৃত্তি সম্রাট কাজী সব্যসাচী ইসলাম ১৯৭৯ সালের ২রা মার্চ ঐহিক জীবনের যবনিকা টেনে পারত্রিক জীবনে পদার্পণ করেন। 

পাঠকের মন্তব্য Login Registration