কাব্য সমালোচনা : পায়ে পায়ে দাঁড়ি কমা : পাখি, রোদ, ডালপালা আর নদীর মহাজনী

প্রতিনিধি | সমালোচনা

বৃহস্পতিবার ২২ নভেম্বর ২০১৮|১৭:৫৬:২২ মি.



রবিউল খাঁ

প্রিয়ভাজনেষু কবি কবীর হোসেনের সম্প্রতি প্রকাশিত কবিতার বই ‘পায়ে পায়ে দাঁড়ি কমা’। শিরোনামের মধ্যে স্বাদ ও ঘ্রাণের ভিন্নতা অনুভব করা যায়। ৬৪টি কবিতার সংকলন এটি। কবীর হোসেন ৯০-এর দশক থেকে লিখছেন।

নিজের ঢাকঢোক পিটাতে অস্বস্তি কবির। প্রচারবিমূখ, নির্ভৃতচারি। কবি হিসেবে আলাদা কোনো অবয়ব নেই। স্বাভাবিক, সাবলিল ও গড়পড়তা মানুষের মতো। ধারণ করেন উচ্চবোধ জীবনবোধ। এ বোধই কবির জ্বালানি। তিনি দেখেন নিবিড়ভাবে ও ভিন্ন বিন্যাসে। নির্সগের চিরচেনা অনুষঙ্গ তাঁর কবিতায় অসামান্য হয়ে উঠে। পাতা কুড়ানির মতো এগুলো সযত্নে সংগ্রহ করে নতুন নতুন কবিতার খোলস বানান।

নগরায়ণের অনাহুত বর্ষণ কবিকে দগ্ধ করে, তিনি লেখেন- ‘ঢুকে পড়েছে ইটের রূপকল্প, পারমানবিক প্রেম...’(পৃ.৭)। স্বাভাবিক গ্রাম্যপ্রকৃতির প্রতিস্থাপনে তিনি ক্ষুদ্ধ হোন-

...গ্রামে গিয়ে দেখি আলো জ্বলছে, ষাট, একশ হাজার পাওয়ার, চাঁদের বুড়ি চরকা ছেড়ে চাকরি নিয়ে চলে গেছে গার্মেন্টসে।

সবকিছুই বদলে যাচ্ছে, যেমন বদলে যাচ্ছে মানুষ। পরিবর্তনের স্রোতে মানুষের নির্মম হয়ে পড়ায় কবি বেশ আহত হন। তাঁর কলম থেকে বেরিয়ে আসে- 
‘এক কোটি মানুষকে আমি কম করে হলেও দেখেছি তিন কোটিবার
দেখেছি বেশভূষা আচার-আচরণসমূহ মানুষের মতন
ভেতর থেকে হৃদয়টাই হয়ে গেছে চুরি’

তিনি পাখি, রোদ, ডালপালা ও নদীর মহাজনী নিয়ে বসেছেন তাঁর কবিতায়। সংবেদনশীলতা ও প্রাকৃতিবাদিতার ছাপ পাওয়া যায় কবিতার পরতে পরতে। জীবনানন্দের কবিতার মতো তিনিও প্রাকৃতিক ম্যাটাফোর ব্যবহারে বিশেষ পারঙ্গম। নিপুঁনভাবে তুলে ধরেছেন ও নৈকট্য অনুভব করেছেন-
‘গাছ, তোমার ডাল ও পাতাকে আমি 
লাগিয়েছি কবিতায় তোমার কাছে আমার ঋণ সারাজীবন
কেউ কাটলে তোমাকে 
যেমন কষ্ট পাও তুমি, তেমনি পাই আমিও (পৃ.৯)।

কবি প্রেমিক পুরুষ। প্রেম তাঁর কাছে দৈনন্দিন জীবনের সবচেয়ে সুস্বাদু ব্যঞ্জন। বিরহ তাকে কাতর করে। পরানের গহীন থেকে উৎসারিত হয়-
ঘুমায় না নদী
কলকল করে সারা রাত
যেন তার বিরহ আঘাত 
মানুষের চেয়েও অধিক (পৃ.১০)

কষ্টরত্ন কবিতায় প্রতিদিনের অস্বীকার, যন্ত্রণা ও শূণ্যভাব ধরা পড়ে অন্য অনুভবে-
আমারতো কেউ নেই সখী!
ডাহুক আমি। রক্তে ভাসাই স্বপ্নের ডিম।
প্রতিদিন দিন হেলে দুলে যাপন করি দিন
আর দেখি সোনা রঙ দৃশে্যর আলোক।

সমকালীন রাজনৈতিক বাস্তবতাও তাঁর কবিতায় ফুটে উঠে। নির্মম রাষ্ট্রাচারের বয়ান পাওয়া যায় আরেক কবিতায় -
ফড়িংগুলো কোথায় খুঁজবো এখন
তাকে কী ধরে নিয়ে গেছে বিএসএফ অথবা অন্য কোনো বাহিনী
পত্রিকার সব সংবাদই যখন প্রেসনোট
তখন বিজ্ঞাপন দিয়েও কী পাওয়া যাবে তার কোনো খবর!

কোথায় খুঁজবো আমাদের ফড়িংগুলো
কোন রাজকোষে জমা হলো সে?

যুগপৎভাবে, তিনি চিকনগুনিয়া ও মশাতন্ত্র কবিতায় লিখেছেন

...মশা মারার কোনো সংবাদ দিতে পারেনি কোনো পত্রিকাও
গুগুল সার্চে এখন হত্যা মানে ক্রসফায়ার।

এভাবেই কবি শব্দ নির্মাণ করেন, শব্দ কাটেন ও শব্দের ওপর অর্থারোপ করেন। ত্যক্ত বিরক্ত কবি অবশেষে শব্দ ও হৃদয় দুটিই কেটে ফেলতে চান-

অথচ কারোও চোখে জল দেখলেই তা সংক্রমিত হয় আমার দু’চোখে
যদিও কবিতায় কান্না এখন দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র
সুন্দরীকে ভালোবাসাও এখন রাজনীতি সংশ্লিষ্ট
তাই যা কিছু শব্দ আসে তাও কাটতে থাকি
কাটতে কাটতে কেটে ফেলি আঙুল ও হৃদয়।

প্রচ্ছদ: ড. শেখ মনির উদ্দিন

পাঠকের মন্তব্য Login Registration