প্রথম থেকেই আমি জয়নুল হতে চেয়েছি: শাহাবুদ্দিন আহমেদ

প্রতিনিধি | সমালোচনা

শনিবার ৩ নভেম্বর ২০১৮|১৯:১৭:০৩ মি.



শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশের চিত্রকলা অঙ্গনে এক স্বতন্ত্র উচ্চারণ। মুক্তিযুদ্ধ-বঙ্গবন্ধু-বাংলাদেশ তাঁর শিল্পের প্রধানতম কাজের এলাকা। অসাধারণ ফিগার ও স্বদেশীয় অনুষঙ্গ ফুটিয়ে তুলতে তিনি অনন্য। দীর্ঘ ঊনচল্লিশ বছর ধরে বসবাস করছেন প্যারিসে। সেখানে বসেই তিনি আঁকছেন বাংলাদেশ। এরকম আরো নানান প্রসঙ্গে তাঁর সঙ্গে কথা হয় ঢাকাস্থ তাঁর কলাবাগানের বাড়ির ছাদে। আলাপে অংশ নেন কবি ওবায়েদ আকাশ ও সাংবাদিক খন্দকার মুনতাসীর মামুন।

ওবায়েদ আকাশ : সত্তরের দশকে আমাদের চিত্রকলায় বিমূর্ত ধারা প্রচলিত ছিল। সবাই যে ধারায় কাজ করল আপনি কিন্তু সেখান থেকে অনেকটাই আলাদা হয়ে গেলেন। এই আলাদা হওয়ার কারণ কী বা এই ভাবনা আপনার মধ্যে কীভাবে কাজ করল?
শাহাবুদ্দিন : সত্তরের দশকের আগেই কিন্তু বিমূর্ত ধারার ভাবনাটা ছিল। তোমার প্রশ্নের উত্তরে সহজ জবাব হলো, ঐ ধারা আমার ভালো লাগে না, তাই আমি যাইনি। ভালো লাগলে তো যেতামই। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ছবিই আমাকে উৎসাহিত করেছে। কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী সবারই তো একটা ভালো লাগার দিক থাকে। ঐটাই আমাকে টেনে নিয়েছে। কে কী বলল, তাতে আমি মাথা ঘামাইনি। যা আমার ভালো লাগে তাই আমি জীবনভর করে গেছি। বিমূর্ত ছবি কিন্তু আমি ৭৫, ৭৬, ৭৭-এ প্যারিসে গিয়ে করেছি। করার পর দেখেছি আমি তৃপ্তি পাই না, আনন্দ পাই না, কোন রিঅ্যাকশনই হয় না আমার। তারপর ছেড়ে দিলাম। এবং ছেড়ে দিয়ে হতাশায় ভুগলাম। মনে হলো এজন্য তো এত কষ্ট করে এই দেশে আসি নি। সেসময় দেশের পরিস্থিতি ভালো ছিল না। ঐ বিশৃঙ্খলার মধ্যে দেশ ছেড়েছি। ’৭৫ থেকে ’৭৮ পর্যন্ত আমাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। 

ওবায়েদ আকাশ : আমরা যখন বাড়ি থেকে দূরে থাকি তখন বাড়ির কথা বেশি মনে পড়ে। আমরা জানি যে, আপনি প্যারিসে ছিলেন, এবং এখনও থাকেন সেখানেই। কিন্তু আপনার কাজগুলোতে বাংলাদেশই প্রাধান্য পায়। আমরা দেখতে পাই, আপনি আসলে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশ নিয়েই কাজ করেছেন। প্যারিসে থাকার কারণে একাজগুলো করতে কি আপনার বেশি সুবিধা হয়েছে নাকি দেশে থাকলে আপনি বাংলাদেশকে আরও বেশি ধারণ করতে পারতেন?
শাহাবুদ্দিন : নিঃসন্দেহে বলা যায়, প্যারিসে থেকেছি বলেই এতকিছু করা সম্ভব হয়েছে। দেশে থাকলে কী হতো, না থাকলে কী হতো সেটা আলাদা ব্যাপার। কিন্তু বাস্তবতা হলো ওটা না হলে হয়ত আমি ঐ গভীরতাটা উপলব্ধি করতে পারতাম না। তুমি যে কথা বললে, বাড়ি থেকে দূরে থাকলে বাড়ির প্রতি টান বাড়ে, কথাটা আমিও মানি। বিদেশে  হরেক রকম  প্রতিযোগিতা; তবে এর মধ্যে  ভালো ছবি দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। সেখানে বিশ্বের কত কী ছিল, ইন্টারনেটে কিংবা মোবাইলে দেখা আর সত্যি সত্যি দেখা কিংবা সে ছবির সংস্পর্শে আসা তো আর এক নয়, তাই না? সে অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। তবে সেখানে আমি আমার অস্তিত্বের কোন ঠিকানা পাইনি। ছোটবেলা থেকেই আমার স্বপ্ন ছিল জয়নুল আবেদিন হবো। আমি কিন্তু অন্য কোন কিছুই চিন্তা করিনি। প্রথম থেকেই আমি জয়নুল আবেদিন হতে চেয়েছি।

ওবায়েদ আকাশ : প্যারিসে আপনি অনুসরণ করার মতো কাউকে পেয়েছিলেন কিনা। অর্থাৎ আমি বোঝাতে চাইছি, আপনি যে ধারায় কাজ করতেন তেমন কেউ কি ছিলেন ওখানে, যাকে অনুসরণ করা যায়?
শাহাবুদ্দিন : না। এজন্যই তো বললাম, ওখানে গিয়ে প্রথমদিকে ফ্রাস্ট্রেশনে ভুগেছি যে, কিসের জন্য আসলাম। বিমূর্ত ছবি দেখি, নানা এক্সিবিশন দেখি, কারো কোনকিছুই আমাকে টানে না।

ওবায়েদ আকাশ : তাহলে কি আমরা মনে করতে পারি যে, বিশ্বের মধ্যে শুধু জয়নুলকেই আপনি আদর্শ মেনেছেন?
শাহাবুদ্দিন : হ্যাঁ। তবে এই আদর্শ ভাবার কারণ শুধু তাঁর ছবি নয়, আমার সুযোগ ঘটেছে ওনার সঙ্গে থাকার, ওনার সঙ্গে ঘুরে বেড়ানোর। ওনার সঙ্গে আউটডোরে গিয়েছি। ওনার অনেক সমালোচক ছিলেন। তারা জয়নুলকে যেমন মানতে চাননি, তেমনি আমার সঙ্গে ওনার এই যোগাযোগও ভালোভাবে নেননি। অনেকেই ঈর্ষান্বিত হয়ে বলতেন, এই যে জয়নুল আবেদিনের চামচা এসেছে। তবে আমি এতে গর্বিত হতাম। ভাবতাম, বাহ্‌, আমাকে ওরা চামচা বলে। কার চামচা? জয়নুল আবেদিনের চামচা। এখন যদি বলি বঙ্গবন্ধুর চামচা তুমি? ক্যান ইউ ইমাজিন, ইউ উইল বি দ্য হিরো। তো যা বলছিলাম, আমি কিন্তু তখনও মাঝে মাঝে দেশে এসেছি, এক্সিবিশনও করেছি। ঠিকই প্রশংসা পাচ্ছি। সবই হচ্ছে। কিন্তু ওখানে গিয়ে আমি তো নিজেকে জাজমেন্ট করছি যে আসলে আমি কিছুই করে উঠতে পারি নি। এই জাজমেন্টটা করাই হতো না যদি না আমি মুক্তিযুদ্ধে যেতাম। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধে না গেলে হয়ত আমি ধ্বসেই যেতাম। তুমি যে কিছুক্ষণ আগে বললে, আমি কেন আমার নিজস্বতা ধরে রাখলাম। এই নিজস্বতা বা স্বকীয়তা ধরে রাখার অনেকগুলো কারণ ছিল, প্রথমত জয়নুল আবেদিন। জয়নুল আবেদিনের ব্যাপারে আমি একদম ব্লাইন্ড। ওনাকে ছাড়া আমি আর কাউকে মনেই ধরি না। দ্বিতীয়ত, আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমার হাতে ফ্ল্যাগ উড়েছে বাংলাদেশের। অর্থাৎ আমার একটা কন্ট্রিবিউশন আছে দেশের জন্য। সেই ভাবনাটা আমাকে ভীষণভাবে তাড়িয়ে বেড়াত। দেশের অনেক গল্প শুনতে পেতাম। শুনতাম, অনেকে হতাশ হয়ে পড়েছে। তখন একটা বিষয়ই আমাকে প্রেরণা দিত যে, ওরা তো স্বাধীনতা দেখে নাই, আমি দেখেছি। আমাকে উঠে দাঁড়াতেই হবে। এই দেশের জন্য আমাকে ভালো কিছু করতেই হবে।
ছয় বছর পড়েছি ওখানে। ওরা তখন বাংলাদেশের ডিগ্রিকে গ্রহণ করত না। আমি বলেছি, আমার ডিপ্লোমা করা আছে। ওরা বলল, না না। ফার্স্ট ইয়ার থেকে আবার করো। ওকে। আমি আবার করলাম। ভাবলাম, আই উইল ফাইট। অনেকে বলল, আরে, তুই এটা কর, ওটা কর, বিমূর্ত কর, আমার সেসব ভালো লাগে না। আমি বুঝলাম আমাকে গ্রাস করার চেষ্টা হচ্ছে। এবং খুব স্বাভাবিক। অবশেষে ’৭৯ সালে ফাইন আর্টস স্কুলে ভর্তি হলাম। প্যারিসে ফাইন আর্টস স্কুল যেটা ইকল দ্য বুজ আর্ট; ফ্রেঞ্চ ইকল অর্থ স্কুল আর বুজ আর্ট মানে ফাইন আর্ট যেটাকে বলে। পৃথিবীর বিশ সেরা ফাইন আর্টের স্কুল। ইকল দ্য বুজ আর্ট এলাকাটিই শিল্পীদের এলাকা। আমাদের যে রকম শাহবাগ। বিশ্ববিদ্যালয়, জাদুঘর সব মিলিয়ে শিল্প-সাহিত্যের একটা পরিবেশ। যেখানে জাঁ পল সার্ত্রের সিক্সটি এইট মুভমেন্ট শুরু হয়েছিল, ওই এলাকাটায়। এলাকাটায় প্রায় আড়াইশ আর্ট গ্যালারি আছে। শিল্পকলা নিয়েই ওখানকার যতসব কাজকারবার। ঐখানেই সব গ্যালারি। তিনটা রোড। একটা স্কুলে আড়াইশ গ্যালারি পৃথিবীর আর কোথাও নাই। তাঁর মধ্যে দশটা হলো টপ। আর বাকিগুলো একেকটা একেক ক্যাটাগরির। যেমন ধরো আমাদের চারুকলা ইনস্টিটিউট। ওখান থেকে বের হলে শাহবাগের সড়ক। সামনে সোহরাওয়ার্দী পার্ক। ওখানে হল; সামনেই রোড; কিন্তু রোডের পাশে সব গ্যালারি। ঐ রোডের নামও আবার ফাইন আর্টস রোড।
আমার সব বন্ধুদের দেখতাম চার বছর পড়ার পর ফাইলপত্র গুছিয়ে নিয়ে গ্যালারিতে দেখাত। আমি এসব কখনও করি নি। তবে আমি বিভিন্ন গ্যালারিতে উঁকিঝুঁকি দিতাম। ঢুকেও পড়তাম কোন কোনটায়। কিন্তু এর অনেকগুলোই আমার পছন্দ হতো না। যে গ্যালারিটা ফ্রান্সিস বেকনের, আমি একদিন দেখলাম অনেক জটলা সেখানে, পুলিশ-টুলিশ গার্ড দিয়ে ভরা। সব কিছু ব্লক করে দেয়া হলো। কারণ ফ্রান্সিস বেকন এসেছেন সেখানে। আমার কৌতূহল জাগল, কী ব্যাপার? জানলাম, একজন নামকরা পেইন্টার এসেছেন, মিনিস্টারও এসেছেন কয়েকজন। সাধারণত গ্যালারিগুলোতে তখন মিনিস্টাররা আসতেন না। দে ডোন্ট কেয়ার আর্টিস্ট। তো আমি ভিড় ঠেলে দূর থেকে পেইন্টিং দেখলাম। আহ...! একটা বিদ্যুতের স্পর্শ যেন আমি পেলাম সেখানে। এই তো আমি খুঁজছি। অনেক কষ্ট করে আমি গ্যালারির ভেতরে ঢুকলাম। দেখলাম, অনেকেই সেখানে ফ্রান্সিসের অটোগ্রাফ নিচ্ছে। আমি সরাসরি গিয়ে ওর সঙ্গে হ্যান্ডশেক করলাম। তাঁর ছবি দেখে আমি মুগ্ধ। অবশেষে আমি খুঁজে পেলাম যা আমি খুঁজছি, খুঁজে চলেছি। দিস ইজ মি। ওর ঐ ছবিগুলোই আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল।

ওবায়েদ আকাশ : বেকনের কাজের কোন জায়গাটায় আপনি মুগ্ধ হলেন?
শাহাবুদ্দিন : বেকনের কাজের ভেতরে যে সফিস্টিকেশন, যে যন্ত্রণা, সেই যন্ত্রণাটা আমার কাজের সঙ্গে মিলে যায়। তারপর একটু ফিগারেটিভ, সহজ এবং মডার্ন। শোন, একটা কথা বলি। কবি বলো, সাহিত্যিক বলো, সবকিছুতেই এলোমেলো করে এগোলে কিন্তু মার খেয়ে যাবে। যতই ভালো লেখো, সফিস্টিকেট হতে হয়। তাহলেই একটি মাস্টারপিস তৈরি করা যায়। আবার এও ঠিক যে, শিল্পের এই সফিস্টিকেশন কিন্তু অনেক কম পাওয়া যায়।
তো যা বলছিলাম, ফ্রান্সিস বেকনের এক্সিবিশন দেখার পরের দিন থেকেই আমি ওর প্রতিটি পেইন্টিং, ওর সব কিছু মুখস্থ করা শুরু করলাম। এক্সিবিশন ছিল এক মাসব্যাপী। আমি প্রতিদিন তিনবার-চারবার যেতাম। স্কুলের পাশেই ছিল ঐ গ্যালারি। আমি স্কুলে যেতাম আবার ফাঁকে ফাঁকে দৌড়ে চলে যেতাম এক্সিবিশন হলে। অনেকে তখন আমাকে পাগল ভাবতে শুরু করল। ঐ গ্যালারিটা ছিল পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে উঁচু মানের। আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আমি ঐ গ্যালারিতেই একদিন এক্সিবিশন করবো। এবং আমি করেছিলাম।

খন্দকার মুনতাসীর মামুন : গ্যালারিটার নাম কী ছিল?
শাহাবুদ্দিন : গ্যালারিটার নাম ছিল গ্যালারি ক্লোদ বার্নার্ড। যার নামে এই গ্যালারি তিনি এখনও বেঁচে আছেন। স্কুলে সবাই তখন আমাকে ডাকতে শুরু করল স্মল বেকন। মজা করত আমাকে নিয়ে। আমি আবারও প্রাউড ফিল করলাম। এভাবে তিন মাস চার মাস বেকনের কাজের পেছনে লেগে থাকার পর একটা টেকনিক রপ্ত হলো আমার। তাকে ফলো করতে করতেই কেমন করে যেন হয়ে গেল। এর অ্যাডভানটেজটা হলো আমি এনার্জিটা পেয়ে গেছি। কে কী বলল তাতে আমার কিছুই আসে যায় না। আর এক বছর পরে অর্থাৎ ৮০ সালে আমাকে দেশে চলে আসতে হবে। আমার মনে হচ্ছিল, কিছুই করতে পারলাম না। দেশে এসে হয়ত বলব, প্যারিসে অনেক বড় বড় কাজ করেছি। কিন্তু নিজের কাছে কী উত্তর দেব? কাজেই ঐ সুযোগটা যতটা সম্ভব কাজে লাগানোর চেষ্টা করলাম।
প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার সময়, আসার সময় ভাবতে থাকি, চিন্তা করি কীভাবে ব্রাশিংটা হলো, টেকনিকটা কী? ছবির ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করি। অবশেষে চিন্তা করলাম, আচ্ছা ওনারা তো ইউরোপিয়ান, আমি তো ইউরোপিয়ান না, আমার বাড়ি মেঘনা নদীর পাড়ে, গ্রামে। বড় বড় শিল্পীরা কত কী দেখেছে, কত কী ভাবতে পারে, আমি তো সেটা পারবো না, আমি ছোটবেলা থেকে যেটা দেখে এসেছি সেটাই করবো। আর মুক্তিযুদ্ধে যা যা দেখেছি তাই করবো।

ওবায়েদ আকাশ : জীবনানন্দ দাশ ইউরোপীয় কবিতা পড়লেন, কিন্তু রূপসী বাংলার মধ্যে পুরো বাংলাদেশকে বসিয়ে দিলেন, আপনার বিষয়গুলোও মনে হচ্ছে তেমনই...
শাহাবুদ্দিন : ঠিক ঠিক। এভাবেই তো এগিয়ে যায়। তাই না!
তো যা বলছিলাম, এভাবে প্রায় সাত মাস একা একাই চেষ্টা করে গেলাম। এরপর গেলাম গ্যালারিতে। ওখানকার যে মূল গ্যালারি সেটাতে মাতিস, পিকাসো, জ্যাক মেতির মতো পৃথিবী বিখ্যাত সব পেইন্টারের কাজ ঝোলানো আছে। দেখলাম। ঘুরে ঘুরে সব দেখলাম। সর্বশেষ এক্সিবিশন করেছে ফ্রান্সিস বেকন। গ্যালারিতে গিয়ে জানলাম, ওখানে ইতালির এক শিল্পীর আরেকটি এক্সিবিশন  হবে। সেজন্য দরজা আটকিয়ে সব কাজ গুছিয়ে নিচ্ছে ওরা। পরের দিন ওপেনিং। যেহেতু আমি প্রতিদিন যাই, গ্যালারির লোকজন আমার কাছে আসল এবং আমাকে ভেতরে ঢুকতে নিষেধ করল। তবু আমি সাহস করে ঢুকলাম। গ্যালারির যিনি সেক্রেটারি, ছোট্ট একটা সিঁড়ি নিয়ে ছবিগুলো হ্যাঙ্গিং করছে। আমি কোন কিছু না বলে ছবি দেখছি। নতুন নতুন ছবি। গ্যালারিতে আর কেউ নেই। ভাবলাম, উনি যেহেতু একা আছেন, এই তো সুযোগ! ওনার সঙ্গে আলাপটা সেরে নিই। সেক্রেটারির নাম জ্য পাঁজয়ে। আমি গলার স্বর নিচু করে বললাম, জ্য পাঁজয়ে, ক্যান আই আস্ক ওয়ান কোশ্চেন? উনি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, ইয়েস! আমি বললাম, ডোন্ট এক্সিবিট ইয়াং পেইন্টার হিয়ার? উনি বললেন, নো, ইউ ক্যান সি অল আর সেভেন্টি অর এইটটি পাস্ট। কথা বলতে বলতেই উনি আমার কাছে একটা হেল্প চাইলেন। একটা পেইন্টিংয়ে সুতা লাগবে টানানোর জন্য। তো আমি সঙ্গে সঙ্গে সুতাটা এনে দিলাম। আমি আবার বললাম, আচ্ছা যদি কোন অসাধারণ তরুণ পেইন্টার তোমাদের গ্যালারিতে এক্সিবিশন করতে চায়, তোমরা কি তাকে দেখবে না? কথাটা শুনে ও মই থেকে নেমে এল। বলল, অবশ্যই, তুমি কোন দেশ থেকে এসেছ? ও ভাবছিল আমি হয়ত ভারতীয়। আমি বললাম, বাংলাদেশ। দেশের নাম শুনে ও বেশ অবাক হলো। জিজ্ঞেস করল, বাংলাদেশে পেইন্টার কতজন আছেন? আমি বেশি বেশি করে বাড়িয়ে বললাম। ও এবার আমাকে বলল, তুমি কি কাল আমাকে তোমার স্লাইড দেখাতে পারবে? আমি খুব খুশি হয়ে গেলাম শুনে। যেখানে সবসময় সবার কাছে শুনেছি, এই গ্যালারিতে বড় বড় শিল্পীরা এক্সিবিশন করে। আমার প্রফেসর একবার ফাইলপত্র নিয়ে গিয়েছিল, দেখে ওরা নাকচ করে দিয়েছে। যখন আমার কাছে স্লাইড চাইল, আমার তো রাতের ঘুম হারাম! যা হোক, স্লাইড নিয়ে গেলাম পরদিন। যে ছবিগুলো দেশে আমি এঁকেছি সেগুলো বেছে বেছে নিয়ে গেলাম ওকে দেখানোর জন্য। তিরিশ চল্লিশটা ছবি। দেখে বলল, ওয়াও, ইন্টারেস্টিং! ওকে, আই উইল টক উইধ মিঃ বার্নার্ড (গ্যালারির প্রেসিডেন্ট)। সো, কাম, আফটার টু ডেইস। আমি খুব ভরসা পেলাম। জানি, খারাপ হলে ওই রিজেক্ট করে দিত, আর রিজেক্টের কাজটা মেইনলি ওই করে। তিন দিন পর ও জানালো, বার্নার্ড আমার আসল কাজগুলো দেখতে চায়। আমি তো তখন খুশিতে আত্মহারা! পরের দিন আমার বন্ধুর গাড়িতে করে তিনটি পেইন্টিং নিয়ে গেলাম। কিন্তু পেইন্টিং নিয়ে যাওয়ার পর বার্নার্ড জ্য পাঁজয়েকে বলল, গিভ হিম দ্য এড্রেস। এবার আমাকে বলল, দে উইল টেক ইউ দ্য গ্যালারি, দে আর মাই ফ্রেন্ড। গো অ্যান্ড টেল দেম আই সেন্ড ইউ। আমাকে জ্য পাঁজয়ে ছোট একটা কাগজে বার্নার্ডের নাম দিয়ে লিখে দিল যে, ওকে আমি পাঠালাম, তুমি একসেপ্ট করো। আমি ওদের সঙ্গে কথা বলে রুম থেকে বের হয়েই কাগজটা ছিঁড়ে ফেলে দিলাম। আমার বন্ধুটা বলল, হায় হায়, করিস কী? তুই ঐটা ফেলে দিলি! আমি বললাম, আই ওয়ান্ট হিয়ার, নট আদার। আমার কাজ এখনও হয় নাই, দে ডোন্ট লাইকড ইট।
চলে আসলাম। মন খুব খারাপ। আবার কাজ শুরু করলাম। মনে মনে ভাবলাম, নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে। জ্য পাঁজয়ে বলেছে, তোমার পেইন্টিংটা একটু টাইট করো। আমি তখন এই ‘টাইট’ কথাটার উপর গুরুত্ব দিচ্ছি। ভাবতে থাকলাম, টাইটটা আসলে কী? খুবই দার্শনিক একটা শব্দ, তাই না! খুঁজে খুঁজে এই যে সিমপ্লিসিটি, এই যে স্পেস, এই যে টাইট- ভায়োলেন্স, এগ্রেসন, সব এক জায়গায় নিয়ে আসলাম। আমার জীবনের খণ্ড খণ্ড ঘটনাগুলো আমার ব্রাশে রাঙিয়ে নিয়ে তিন মাস পর আবার গেলাম। ইতিমধ্যে কিন্তু আমার স্কলারশিপ শেষ, বাংলাদেশে ফেরার টিকিট কাটাও হয়ে গেছে। আমি কিন্তু তখনও এপ্লাই করছি পুলিশের কাছে যে, আমি ওখানে প্রফেশনাল আর্টিস্ট হিসেবে থাকতে চাই। ঐ দেশে তখন এমন নিয়ম ছিল যে, যদি কোন শিল্পীকে কোন আর্ট গ্যালারি প্রফেশনাল আর্টিস্ট হিসেবে একসেপ্ট করে তবে সে সেখানে থেকে যেতে পারে। আর্টিস্টদের এই এডভান্টেজটা ছিল। সে-কারণেই থেকে যেতে পেরেছিলাম। যা হোক, এপ্লাই তো করছিলাম, কিন্তু আমার কাছে তখন টাকাপয়সা ছিল না। কাজ করতে করতে আমার ঘর ছবিতে ঠাসা। স্কুলের সবার কাছে আমি তখন ঈর্ষার পাত্র। সবাই আমার রুম দখল করে নিতে চায়। প্রফেসরকে কাকুতিমিনতি করে বলছি, প্লিজ স্যার, আমাকে আর ছয় মাস সময় দিন। আর অল্প কিছু কাজ বাকি। স্কুলের অন্যরা আমাকে হিংসা করলেও ওরা একটা জিনিস কিন্তু ঠিকই ধরতে পেরেছিল যে, আমার কাজে র‌্যাডিক্যাল চেঞ্জ এসেছে। কাজের ভেতরে বুঁদ হয়ে থাকার কারণেই কিন্তু এই পরিবর্তন। সকাল আটটায় স্কুল খুলত, বন্ধ হতো রাত দশটায়। এর মধ্যে অনেকে হাফ কাজ করে বাড়ি চলে যেত, পরে আবার আসত, কেউ ফাঁকি দিত, যারা সিরিয়াস তারা অনেকটা সময় কাজের মধ্যে থাকত। আমি তখন সকাল আটটায় যেতাম, রাত সাড়ে দশটায় ফিরতাম। সকালে কফি খেতাম, দুপুরে কফি খেতাম আর সিগারেট। এছাড়া কিছুই খেতাম না। রাতে এসে ভাত আর ডাল খেতাম। মোট নয় মাস এভাবেই কেটেছে। এতে আমার আলসার হয়ে গেল। আর এই যে নয় মাস, এতেই আমার উত্তরণ। এরপর যখন গ্যালারিতে গেলাম, ওরা আমার কাজ দেখে একসেপ্ট করল। বলল, ডোন্ট টক এনি বডি। আমরা তোকে একসেপ্ট করলাম। তোর ড্রয়িং দেখতে চাই। আমি তো মহাখুশি! গ্যালারি ক্লোদ বার্নার্ড আমাকে কাজের সুযোগ দিয়েছে। আমার বয়স তখন ৩১। কেউ এত কম বয়সে এমন সুযোগ পায়নি এর আগে।
বড় গ্যালারি। পাঁচজন প্রফেশনাল আর্টিস্ট কাজ করে ওখানে। নতুন যাদের নিয়োগ করছে সবাই তরুণ। ওরা ওদের দর্শন চেঞ্জ করেছে তখন। পাশে আরেকটা নতুন রুম কিনল ওরা। বলল, এই রুম শুধু ইয়াং পেইন্টারদের জন্য। পাঁচজন ইয়াং পেইন্টার সেখানে শাহাবুদ্দিন নাম্বার ওয়ান। আমাকে থাকার জন্য ছোট একটা ঘর দেয়া হলো বিনে পয়সায়। হোস্টেলের সবার নজর আবার আমার দিকে। ভাবখানা এমন যে, বিনে পয়সায় থাকবে এই নতুন অতিথিটা কে? যা হোক আমি কিছু কাগজ জোগাড় করলাম আর কয়লা নিলাম। কাগজ দিয়ে রুমের দরজা-জানালা, ছাদ সব বানিয়ে ফেললাম। অনেকটা মাইকেল এঞ্জেলোর মতোই। আমি এখন ভাবি যে, কী করে করলাম এত কিছু। একটা ওভেন ছিল ওখানে শুধু ডাল আর ডিম ভাজি করতাম। যা হোক, এভাবে আবার পড়ে থেকে তিন সপ্তাহ ড্রয়িং করলাম। কখনও আমি নিজেই মডেল হলাম, নিজেকে নগ্ন করে শরীরের প্রতিটি পেশির ছবি আঁকলাম। ছবির ভেতরে নিজের ভাবনাকে ভাঙলাম, বিশ্লেষণ করলাম। টিভিতে যে খেলা দেখাত তাঁর স্লো মোশন দেখতাম। স্পিড দেখতাম, ইমোশন দেখতাম। ভাবতাম, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা তো লাফিয়ে ঝাপিয়ে লড়াই করেছি, সেই আবেগ, সেই অনুভূতিগুলোই আমার এখন দরকার। তিন সপ্তাহ পর যখন অথোরিটিকে দেখালাম তখন উল্টো একটা ব্যাপার ঘটল। ওরা দেখেটেখে বলল, পেইন্টিং আর হবে না, আমার ড্রয়িং এক্সিবিশন হবে গ্যালারিতে। আমি ভাবলাম, হোক, যেটা খুশি হোক, কোন সমস্যা নেই। অবশেষে ঐ বিখ্যাত গ্যালারিতে আমার ড্রয়িং এক্সিবিশন হলো, তাও এক দিনের জন্য। কী ঘটল, এক্সিবিশন হবে, আমার ছবি বাঁধাই হয়েছে, কন্ট্রাক্ট সাইন-টাইন আরও অন্যান্য হাবিজাবি হচ্ছে। ওরা বলল, ওরা সব ছবি কিনে নেবে, ওদের ইচ্ছামতো দামে আমার ছবি বিক্রি করবে। আমাকে বলা হলো, তুমি কত চাও? আমি বললাম, আমি জানি না ভাই। তখন আমার কাছে ঐ গ্যালারিতে এক্সিবিশন করাটাই একটা বিশাল ব্যাপার। ছবির দাম নিয়ে ভাবব কেন? ওরা বারবার বলছে, বল বল, কত চাও। আমি হেসে বললাম, তিনশ হলেই হবে। ওরা বলল, তিনশ তো কিচ্ছু না। আমি বললাম, তোমরা কত করে বিক্রি করবে? ওরা বলল, তিনশ না, আমরা তোমাকে ছয়শ দেব, আমরা হয়ত তিন হাজার করে বিক্রি করবো। ওদের কথা শুনে আমি তো অবাক! কই তিনশ আর কোথায় তিন হাজার! যা হোক, ঐ একদিনের এক্সিবিশনের জন্য আই গট এভ্রিথিং। বাড়ি পেয়েছি, অন্য গ্যালারি পেয়েছি, ওখানে থাকার পারমিশন পেলাম, সিরাক সাইন করেছে আমার স্টুডিওর জন্য, সব! ঐ একদিনের জন্য।

ওবায়েদ আকাশ : আপনার কাজে যে একটা গতি, আবার দেশের শিল্পবোদ্ধারা সবাই আপনার কাজে গতির কথাটা বলে। এই গতি কি ঐ ঘটনার পর থেকে আসলো নাকি আগে থেকেই ছিল?
শাহাবুদ্দিন : অবশ্যই আগে থেকে। তুমি আমার আগের কাজগুলো দেখবে। সোনালী ব্যাংক কিংবা আরও অন্যান্য জায়গায় আমার পুরনো কাজগুলো আছে, সেগুলো দেখবে। আমি তো বারবার বলছি, আমার ভেতরে জয়নুল আবেদিনের ইনফ্লুয়েন্স ছিল। এবং উনি আমাকে হাতে ধরে ধরে কাজ শিখিয়েছিলেন। এভাবে বলতেন যে, এইটা একটু ছেড়ে দে, ছেড়ে দে... আবার বলতেন ঐটা আরেকটু টান দে, এসব থেকেই তো আমি অনুপ্রেরণা পেয়েছি। হ্যাঁ আগে থেকেই গতিটা ছিল। মাঝে কিছুটা দমে গিয়েছিলাম। দেশের পরিস্থিতির কারণে ধ্বসে গিয়েছিলাম অনেকটা। বঙ্গবন্ধু না বললে তো আমি বিদেশেও যাই না। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, তোরা দেশকে স্বাধীন করেছিস, পিকাসোরে মাইর দিবি, পারবি না! একজন বাবা যেমন করে বলেন তেমন করেই বলতেন, স্নেহ করতেন। আই ফেল্ট, হি ইজ মাই ফাদার। কত বড় আশা ছিল তাঁর। পিকাসোকে হারিয়ে দেয়ার কথা বলতেন। একদম শিশুসুলভ কথা! কিন্তু আবারও বলছি, দেশকে নিয়ে, দেশের মানুষগুলোকে নিয়ে কত বড় স্বপ্ন ছিল তাঁর। ঐ কথাগুলোই আমার মনে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করত।

ওবায়েদ আকাশ : বঙ্গবন্ধু তো প্রায়ই বলতেন, আমার দুইজন বন্ধু আছে, একজন কবি একজন শিল্পী। কবিবন্ধু হচ্ছেন পল্লীকবি জসীমউদ্দীন আর শিল্পীবন্ধু হচ্ছেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। জয়নুল আবেদিনের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বন্ধুত্বের বিষয়টা নিয়ে যদি কিছু বলতেন।
শাহাবুদ্দিন : এটা আরও বড় গল্প! জয়নুল আবেদিন সাহেবের বাসায় প্রতিদিন সন্ধ্যায় আমি যেতাম। এটা আমার ডিউটি ছিল, প্রতিদিন সন্ধ্যায় ক্লাস সেরে, ঐ বাড়ি হয়ে ঘরে ফিরতাম। প্রতিদিন! আর উনিও এতে খুব এনার্জি পেতেন। আমি ওনাকে গুরু মেনে নিয়েছিলাম। হয় না, বড় বড় সঙ্গীতগুণী বা পণ্ডিতদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করতেন ছাত্ররা, তেমনি আমিও ওনাকে গুরু মেনে নিয়েছিলাম। আমাকে বঙ্গবন্ধু যে উৎসাহ দিচ্ছিলেন তা তো কাউকে বলিনি, অন্তরে রেখে দিয়েছিলাম। একদিন সাহস করে জয়নুল আবেদিনকে বললাম, বঙ্গবন্ধু তো বলেছেন, আমি কি ইউরোপে যাব? উনি বললেন, হ্যাঁ যাবে না কেন? যাও, যাওয়া উচিৎ। একটু দেখে আসো না, ওখানে কী কী হচ্ছে। ভালো না লাগলে চলে আসবা। আমি খুশি হলাম। জয়নুল আবেদিন তখন বললেন, তুমি তো ঐদিকে যাও, ওনার আশেপাশের লোকগুলো তো বেশি সুবিধার না, ওনাকে একটু বলো না, কিছু ভালো লোক যেন নেয়। আমি বললাম, কেন, আপনি যেতে চান ওনার কাছে? জয়নুল বললেন, না না, আমি না। যেমন হাসান হাফিজুর রহমান, কাজী মোতাহার হোসেন উনাদের নিয়ে যাও। আমি তখন ওনাদের চিনি না। কাজেই ইম্পরটেন্সও দিচ্ছি না। আমি ভাবছি, উনিই যাবেন কি না। উনি বললেন, না না, আমি বঙ্গবন্ধুর কাছে গেছি একদিন। যা হোক, আমি ওনার কথামতো গেলাম বঙ্গবন্ধুর কাছে। গিয়ে দেখি, ভিড়ভাট্টা। আমি কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বললাম, বঙ্গবন্ধু, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সাহেব আপনার সাথে একটু দেখা করতে চান। উনি সঙ্গে সঙ্গে বললেন, কী বললি! হায় হায়, আরে উনি কেন, আমারই তো ওনার কাছে যাওয়া উচিৎ, উনি একজন গুরু, উনি কেন আমার কাছে আসবেন! তোফায়েল, এই হানিফ, হানিফ, গাড়িটা লাগাও তো! আমি বললাম, কী বলেন বঙ্গবন্ধু, আপনি এভাবে হুট করে যাবেন! না না, আপনি এভাবে যেতে পারেন না। বঙ্গবন্ধু বললেন, শোন, আমাদের তো কিছুই নাই রে! ওনারাই তো বাঁচায়ে রাখলেন দেশ। অবশেষে আমি ওনাকে থামাতে পেরেছিলাম। উনি বললেন, কালকে নিয়া আসিস। আমার জন্য তো দুজনই ইম্পরটেন্ট। পরদিন জয়নুল আবেদিন সাহেবকে বঙ্গবন্ধুর বাসায় নিয়ে গেলাম। দুজনই এঁকে অপরকে বলতে শুরু করলেন, আপনি বসেন, আপনি বসেন। কেউ আর বসেন না। আমি এসব দেখে দুজনকেই চেয়ার দিয়ে দিলাম। বঙ্গবন্ধুর ভেতরে তো তখন পুরোটাই বাংলাদেশ। কথা বলতে বলতে উনি বললেন, আপনি কী চান? শিল্পাচার্য বললেন, একটু সোনারগাঁ। শুনেই বঙ্গবন্ধু বলে উঠলেন, হ্যাঁ, সোনারগাঁ, রফিকউল্লাহ চৌধুরী (তখন বঙ্গবন্ধুর সেক্রেটারি) তুমি জানো সোনারগাঁ? এই নিন পুরো সোনারগাঁ, আপনার জন্য! আমার সামনে মাত্র এক মিনিটের মধ্যে কাগজ-টাগজ সাইন হয়ে গেল। জয়নুল আবেদিন সাহেব কিছু আর বলেন না। আমার চোখের সামনে দেখলাম, সোনারগাঁ লোকশিল্প জাদুঘর হয়ে গেল। একেই বলা হয় ভালোবাসা। এখানেই সব দর্শন! উনি যে এসেছেন এবং এত বড় শিল্পী ওনাকে অনুরোধ করেছেন, এটাতেই বঙ্গবন্ধু লজ্জিত হচ্ছিলেন।

ওবায়েদ আকাশ : সাম্প্রতিককালে আমাদের চিত্রকলার চর্চায় গ্রাফিক্স, অ্যানিমেশন অনেক কিছু চালু হয়েছে। এই ধারাটা নিয়ে আপনি কতটা আশাবাদী বা এ নিয়ে আপনার ভাবনাটা কী?
শাহাবুদ্দিন : আশাবাদী তো বটেই। একটা জিনিসই শুধু ক্ষতিকারক হবে যে, ওদের ব্রেইনে ইকোনমিটা আগে আসছে। এটাই একটু সমস্যা। এটা আগে ছিল না।

ওবায়েদ আকাশ : ওদের এই কাজের ধারায় কি বাংলাদেশটা এসেছে?
শাহাবুদ্দিন : টেকনিক্যালি কাছাকাছি এসেছে। আগে তো টেকনিকটাও জানত না। তবে সব জিনিসেরই প্রয়োজন আছে। না হলে তোমার মূল্যায়ন হয় না। পঁচা, ভালো- সব কিছু থাকলেই মূল্যায়ন করার সুযোগ থাকে। শুধু বাংলাদেশই নয়, পৃথিবীজুড়েই এসব চলছে, অনেক কিছুই এখন ইন্ডাস্ট্রিয়াল ব্যবসায়ীদের হাতে চলে গেছে। এর মানে এই নয় যে, এসব ঘরে ঢুকবে, বরং ঘরের থেকে বাইরে নিচ্ছে সবকিছু। ইন্ডাস্ট্রি, বড় বড় প্রতিষ্ঠান ইন্সটলেশন করছে, আবার ভেঙে ফেলছে। ইটস আ নিউ কাইন্ড অব ফিলোসফি, যে ফিলোসফি থার্ড ওয়ার্ল্ড কান্ট্রির জন্য ডেঞ্জারাস! তবে মনে রাখতে হবে এটা তো প্রয়োজন। না হলে এগোবে কী করে?

ওবায়েদ আকাশ : জয়নুল আবেদিন অবশ্যই অনেক বড় মাপের শিল্পী এবং আপনার আইডল ছিলেন। আপনি গর্ববোধ করতেন, উনার চামচা বলে। এর বাইরে যে একটা বিশাল জগত আমাদের চিত্রকলার। এদের ব্যাপারে আপনার মূল্যায়ন কী? যেমন আমিনুল ইসলাম, এস এম কিবরিয়া...
শাহাবুদ্দিন : হ্যাঁ আজ সকালেই আমিনুলের কথা বলছিলাম। আমিনুল আমিনুল। উনার কাজের যথেষ্ট কদর আছে।

ওবায়েদ আকাশ : আর হাশেম খান, মুর্তজা বশীর, রফিকুন নবী, কাইয়ুম চৌধুরী?
শাহাবুদ্দিন : না না উনাদের কাজ ঐ পর্যায়ের না। আমিনুল ইসলাম, এস এম কিবরিয়ার সাথে উনাদের পার্থক্য আছে। দেখো, তুমি তো কবি। কবি হিসেবে দেখো, কয়জনইবা কবিতা বোঝে? কয়জন পড়েইবা, কিন্তু দেখো বাংলাদেশে কবি হিসেবে যারা আছেন তাদের প্রতি জাজমেন্ট তো ঠিকই হচ্ছে। কে করে এগুলো? জনগণ করে? কে করে? হু ডিসাইড? তুমি, যারা এই কাজে আছেন তারাই করেন। সেইম উইধ পেইন্টিং। আমি জানি যে, কার ছবি ভালো। আমি নিজেই কিন্তু বলবো, ওর কাজটা খুব ভালো লাগলো রে! দেখলে, ডিসিশন কিন্তু জনগণ নেয় না, শিল্পীমহল থেকেই হয়, তারপর সেটা ছড়িয়ে যায়। এটা তো ক্রিয়েশন, তাই না। ক্রিয়েশন শব্দটা কিন্তু খুব ডেঞ্জারাস! এটাকে সস্তা করে ফেলছে অনেকে। যারা ইম্পরট্যান্ট, তারা জীবনেও কিন্তু বলে না আমি ক্রিয়েট করলাম, এইটা করলাম, ঐটা করলাম। এসব চিন্তাও করে না। কম্পিটিশন যখন কম, তখনই ঐসব বলে ফেলে।

ওবায়েদ আকাশ : আরেকটা জিনিস জানতে চাই যে, একজন ক্রিয়েটিভ মানুষ বা একজন শিল্পী বা কবি যখন দেশের বাইরে গিয়ে জীবনযাপন করেন বা এই যে আপনি দেশের বাইরে আছেন, অনেকেই আছেন, একে আপনি কীভাবে দেখেন? এর সঙ্গে আরেকটু যোগ করি, শেষে কি আপনি দেশে আসতে চান? ফিরে আসতে চান?
শাহাবুদ্দিন : ফিরে তো আসতে চাইই। আমার যখন যৌবন, অর্থাৎ যখন আমি ২৪ বছরের ছেলে তখন আমি ওখানে গেছি, আর এখন আমার বয়স ঊনসত্তর। ওটা আমার সেকেন্ড হোমল্যান্ড। এতগুলো বছর আমি ওখানে আছি। ওটাও কিন্তু আমার মাটি। এটাই বাস্তবতা। কোন থিউরি-টিউরি না। আমার অবশ্যই এফেকশন আছে। তা না হলে এত বছর থাকি কী করে? এবং দে মেইড মি অলসো। অনেক দুঃখ-বেদনা সহ্য করেছি, অনেক কষ্ট করেছি, তবে এট দ্য সেম টাইম আই অ্যাম দ্য ফোর্থ ক্লাস। আই অ্যাম নট ফ্রেঞ্চ। তারপরও যেহেতু মাটির একটা গন্ধ আছে, এবং আমার মাটিরও একটা গন্ধ আছে, এই দুইয়ের সমন্বয়, হয়ত এ কারণেই আমি নতুন কিছু একটা আবিষ্কার করার চেষ্টা করছি।
৪১ বছর আমি ঐ দেশে আছি। এটা অনেক বড় সময়। এই ৪১ বছর পর অনেক জিনিস আছে, যেটা ওদের চেয়ে ভালো আমি জানি। কেন আমি বলছি শোনো। যেমন আমি লন্ডনে যেতে পারতাম, সেখানে লক্ষ লক্ষ বাঙালি। সেটা আমার জন্য হয়ত অনেক ভালো হতো। আমি ভাবলাম, এই যে ঋষি-মুনিরা বটগাছের নিচে বসেই থাকে, বৃষ্টি হলেও বসেই থাকে। সারাদিন বসে বসে ধ্যান করে। এই ধ্যানের শক্তিটা ওরা পায় কোথায়? আমার কাছে মনে হয়, এই একটা জায়গায় ঝিম মেরে বসে থাকার মাঝেই শক্তিটা আছে, সেজন্য কোথাও যাই না। আরেকটা ইগো আমার মধ্যে কাজ করে। একদম উগ্রবাদীদের মতো। যে দেশ এবং যে দেশের অস্ত্র আমার দেশের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে গেছে, সেখানে আমি কখনও থাকতে পারি না, যেমন চীন, যেমন আমেরিকা। ঐসব দেশে আমি কখনই যেতে চাই না।-রাইজিংবিডি

পাঠকের মন্তব্য Login Registration