সৌন্দর্যের অপ্সরী শিল্পাচার্য জয়নুল ও জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা

প্রতিনিধি | সমালোচনা

মঙ্গলবার ১৪ আগস্ট ২০১৮|১৮:০৩:৪৪ মি.



আজহারুল হক, গফরগাঁও থেকে: ব্রহ্মপুত্র নদের তীরঘেঁষা ময়মনসিংহ শহর। শিশু জয়নুল খেলে করে বেড়াতেন ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে পাড়ে। শীত, গ্রীষ্ম ও বর্ষা- কিছুই তাকে ঘরে আটকে রাখতে পারত না। কেননা নদী ছিল জয়নুলের প্রিয় শিক্ষক। 
শীতের শান্ত নদ কুয়াশার চাদরে ঢেকে গেলেও নৌকায় ঝুপঝাপ দাঁড়ের শব্দ, সারি বেঁধে গুনটানা, জেলেদের মাছ ধরা, মেয়েদের কাপড় কাচা, ঘাট থেকে রমণীদের কলসি কাঁখে পানি নিয়ে বাড়িফেরা, পালতোলা নৌকা, খেয়া নৌকায় করে যাত্রী পারাপার- এসব তন্ময় হয়ে দেখত শিশু জয়নুল। 

নদের পাড়ে দাঁড়িয়ে দূরে নীল-নিঃসীম আকাশ দেখতে দেখতে আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো ধূসর গারো পাহাড়ে আলো-ছায়ার খেলা। কনকনে হাওয়ায় ব্রহ্মপুত্র নদের অপার মুগ্ধতার এই সৌন্দর্যই হয়তো জয়নুল আবেদিনকে শিল্পাচার্য বানিয়েছে। 

প্রকৃতির এই অপরূপ সৌন্দর্য কার না মন কাড়ে? রোমান্টিক পরিবেশে যেন মায়ার ইন্দ্রজাল বুনেছে প্রকৃতি। ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে এখনো খেলা করে জয়নুল, খেলা করে জয়নুলের সৃষ্টি। তার সৃষ্টি নিয়ে পূর্ণপ্রাণে প্রতিষ্ঠিত সৌন্দর্যের অপ্সরী শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা।

শহরের পশ্চিম-উত্তর কোণে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরঁঘেষে দাঁড়িয়ে আছে সংগ্রহশালাটি। সামনে এলেই মূল ফটকের বায়ে টিকিট কাউন্টারের উপর পিতলের অক্ষরে বাংলা ও ইংরেজিতে লেখা শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা। যেটি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের একটি শাখা। ফটকের সামনে এই জায়গাটিতে এলেই সকলের মন-প্রাণ ভাল লাগায় ভরে যাবে। 

ব্রহ্মপুত্রের এপারে শহর আর ওপারে গ্রাম। নদ পার হয়ে গ্রামের মানুষেরা কাজের জন্য শহরে ঢুকছে আবার শহরের মানুষেরা একটু অনাবিল শান্তি, বুকভরে শ্বাস নেয় এবং শেকড়ের সন্ধানে নদের ওপারে গ্রামে যাচ্ছে। 

জানা যায়, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের আদিনিবাস ছিল পাবনা জেলায়। বাবা তমিজ উদ্দিন আহমেদ পুলিশের চাকরির সুবাদে ময়মনসিংহ জেলায় আকুয়া মাদ্রাসা কোয়ার্টারে বসত স্থাপন করেন। পুলিশ অফিসার তমিজ উদ্দিন আহম্মেদের চার ছেলে। বড় ছেলে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, মেজ ছেলে জাহিদুল রহিম (লাইব্রেরিয়ান), জনাবুল ইসলাম (আর্টিস্ট) ও জহিরুল ইসলাম (অধ্যাপক) সবাই পরলোকে।
 
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ১৯১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জ শহরের পুরাতন থানায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা তমিজ উদ্দিন আহমেদ তখন কিশোরগঞ্জ থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার।
জয়নুলের জন্ম কিশোরগঞ্জ হলেও সেখানে তার স্মৃতির চিহ্নমাত্র নেই। কিশোরগঞ্জ শহরের অনেক মানুষই জানেন না জয়নুল আবেদিন কে, তার জন্ম কোথায়। ১৯৭৬ সালে মাত্র ৬২ বছর বয়সে এই মহান শিল্পী মৃত্যুবরণ করেন।

কী আছে সংগ্রহশালায়
তিনটি গ্যালারিতে বিভক্ত সংগ্রহশালাটিতে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের শিল্পকর্ম, ব্যক্তিগত স্মৃতি নিদর্শন ও আলোকচিত্র প্রদর্শিত হচ্ছে। মূল ভবনের দ্বিতীয় তলায় গ্যালারিগুলো অবস্থিত। গ্যালারি নং-১ এ জয়নুলের ৫৩টি আলোকচিত্র, ৪টি বোর্ডে জয়নুলের সংক্ষিপ্ত জীবনবৃত্তান্ত, সংগ্রহশালার কি-লেবেল এবং জয়নুলের ১টি পোট্রেট প্রদর্শিত হচ্ছে। গ্যালারি নং-২ এ জয়নুলের মৌলিক শিল্পকর্ম শম্ভুগঞ্জ ঘাট (১৯৩৩), কাগজে কালি ও তুলি; দুর্ভিক্ষ-৫ (১৯৪৩), কাজী নজরুল ইসলাম (১৩৫৩ বঙ্গাব্দ), কাগজে কাঠ কয়লা; রমণী-১ (১৯৫১), প্রতীক্ষা (ঘাটে) ১৯৫১, পিচ বোর্ডে জল রং; মা ও শিশু-১ (১৯৫১), কলসি কাঁখে (১৯৫১), ক্যানভাসে তৈল রং পেইন্টিং (উল্লেখ নেই), ক্যানভাসে তৈল রং; বাস্তুহারা (উল্লেখ নেই), ক্যানভাসে তৈল রং; প্রতিকৃতি (উল্লেখ নেই), ক্যানভাসে তৈল রংসহ মোট ৩১টি মৌলিক চিত্রকর্ম এবং শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ব্যবহার্য ২১টি নিদর্শন আছে।

সম্প্রতি সংগ্রহশালার জাদুঘর ব্যবস্থাপক মুকুল দত্তের একান্ত প্রচেষ্টায় শিল্পাচার্যের ব্যবহার্য পোশাক, সার্টিফিকেট, হাতঘড়িসহ ৩৫টি আইটেম সংগ্রহ করা হয়। এছাড়াও ১০টি পুতুল বিভিন্ন এলাকা থেকে সংগ্রহ করে প্রদর্শিত হচ্ছে।

সংগ্রহশালা কেন এবং কীভাবে তৈরি হলো
সাধারণের শিল্প ভাবনাকে উৎসাহিত করতে এবং চিত্রকলার আন্দোলনকে বিকেন্দ্রীকরণ অর্থাৎ ঢাকার বাইরে ছড়িয়ে দেবার লক্ষ্যে স্বপ্রণোদিত জয়নুল তার মনের ক্যানভাসের আর্ট গ্যালারিটি শৈশবের স্মৃতিঘেরা শহরে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তার এই উদ্যোগ সাধারণের দাবিতে পরিণত হলে ময়মনসিংহের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, গুণীজন, বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ এবং ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসন সম্মিলিতভাবে সংগ্রহশালাটি প্রতিষ্ঠা করেন। তৎকালীন মহামান্য উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১ বৈশাখ ১৩৮২ বঙ্গাব্দ (১৫ এপ্রিল ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দ) ‌শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা'-এর শুভ উদ্বোধন করেন। দীর্ঘদিন প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হওয়ার পর সংগ্রহশালার ট্রাস্ট্রি বোর্ডের অনুরোধ এবং সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনক্রমে ১৯৯৯ সালে সংগ্রহশালার পরিচালনার দায়িত্ব বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর গ্রহণ করে। 

জয়নুলের কিছু বিখ্যাত শিল্পকর্ম 
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সারাজীবন যেসব চিত্র এঁকেছেন তার প্রায় সবগুলোই উল্লেখ করার মতো। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চিত্রকর্ম হল- শম্ভুগঞ্জঘাট, ফসল মাড়াই, মই দেয়া, কালবৈশাখী, খেয়াপার, ঝড়ের মুখে, গুনটানা, নদী ও জেলে নৌকা। ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষ জয়নুলকে কলকাতার একাডেমিক প্রভাব থেকে মুক্ত করে একটি নিজস্ব অঙ্কনরীতিতে প্রতিষ্ঠিত করে। হালকা রং-এর কাগজে কালো কালির মজবুত মোটা ব্রাশের টানে বেগবান ও শক্তিশালী সহজ রেখার প্রকাশবাদী বাস্তব চিত্রকর্মগুলো জয়নুলকে খ্যাতির শীর্ষে অধিষ্ঠিত করেছে এবং এনে দিয়েছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। 

আধুনিক বাঙালি ঢংয়ে আঁকা পল্লী রমণী, আয়না নিয়ে বধূ, মা ও শিশু, তিন রমণী, একাকী বনে, পাইন্যার মা ও বেদেনী আমাদের সমৃদ্ধ লোকঐতিহ্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। জীবন শিল্পী জয়নুলের অসংখ্য চিত্রকর্ম আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসিত হয়। এমন আরো কয়েকটি চিত্রকর্ম হল- কাক, মাছ ধরা, গেরিলা, কেশবিন্যাস, দুই বোন, সাঁওতাল দম্পতি, বিদ্রোহ, সংগ্রাম, নবান্ন ও মনপুরা-৭০ তার অসাধারণ সৃষ্টি। শিল্পাচার্য জয়নুল একজন কালজয়ী শিল্পী।-বাংলাদেশ প্রতিদিন 
 

পাঠকের মন্তব্য Login Registration