গণযোগাযোগের কবি নয়ন আহমেদ

প্রতিনিধি | সমালোচনা

বুধবার ৮ আগস্ট ২০১৮|২০:২৬:৪৪ মি.



তাজ ইসলাম 

 ইথারে ভেসে আসা আওয়াজেও পরিচিত জনের কণ্ঠ চিহ্নিত করা যায় অতি সহজেই। কবিতায় যারা নিজেদের অবস্থানকে দৃঢ় করতে সক্ষম হয়েছেন পাঠকের কাছে তাদের কবিতা স্বতন্ত্র সত্তায় ধরা দেয়। কবিতা অনেকেই লিখেন, নিজেকে আলাদা করার মত সামর্থ অর্জন করেন কেউ কেউ। নব্বইয়ের কবিদের মাঝে নয়ন আহমেদ সেইসব মেধাবী, পরিশ্রমী, প্রজ্ঞাবানদের একজন। তার কবিতায় শব্দের বুনন, নির্মাণ কৌশল, চিন্তার গভীরতা, রূপকের সমাহার তাকে স্বতন্ত্রভাবে পরিচিত করে তুলেছে কবিতার বোদ্ধা পাঠক মহলে। উত্থানকাল থেকে কবিতার আকাশে ক্রমান্বয়ে তার বিস্তৃতি বেড়েই চলেছে। ‘অসম্ভব অহংকার’এ ‘বাসা বদলের গল্প’ বলে তিনি শুরু করেছেন ‘এককাপ গণযোগাযোগ’। ফ্ল্যাপ সূত্র মোতাবেক এটি তার পঞ্চম কবিতা গ্রন্থ। বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে চায়ের সাথে গণযোগাযোগের বিষয়টি ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। একটি অবরুদ্ধ সময়ে যখন একটি শ্রেণী জনবিচ্ছিন্ন হয়ে জনগণকে করে রেখেছেন অপাঙতেয় এবং নিজেরাও হয়ে যাচ্ছেন বিচ্ছিন্ন, তখন কবির উপলব্ধি ‘এককাপ গণযোগাযোগ’ অপরিহার্য। সেই প্রয়োজনীয়তার দাবীতেই রচিত হয় ‘এককাপ গণযোগাযোগ’। এই এককাপ চা পানের স্বল্পতম সময়ে আমরা ভাবতে পারি রৌদ্রের কথা, শুশ্রুষার কথা, এবং ভাবতে পারি এককাপ কলরবের কথা। এই রৌদ্র, কলরব, শুশ্রুষার অবশ্য রয়েছে অন্তর্নিহিত ভাব ও ব্যঞ্জনা। যা ভিন্ন আলোচনার দাবী রাখে। আর আন্তরিকতা থাকলে এই সময়ের মধ্যেই হয়ে উঠা যায় হৃদ্যতার একটি নদী। তাই কবির সহজ অভিব্যক্তি— 
‘হ্যাঁ, চা পান করতে করতে
আমরা এককাপ গণযোগাযোগ হতে পারি।’ (চা পান করতে করতে)

নয়ন আহমেদের কবিতার ভাষা সহজ, শব্দ মোলায়েম এবং সাধারণের পরিচিত। কিন্তু এর ভাব গভীর এবং বোধের বিষয়টি কিছুটা দুর্বোধ্য। কাজেই আমরা অনুধাবন করি তার কবিতার পাঠক আর সাধারণ থেকে পাঠের স্বাদ পেতে সামর্থ নহে, রূপকের আশ্রয়ে রচিত কবিতার অনেক চরণের মর্ম উদ্ধার অনেকের জন্য দুরূহ। যেমন কবি’র এই দুটি কবিতা থেকে দুবোর্ধ্যতার পরিচয় মেলে —
‘কিছুক্ষণ আগে একটা পেঁপের স্বভাবে নিজেকে গেঁথেছি।
 কষের ভেতর এমন সম্পর্ক থাকে শুয়ে!’ (স্বভাব)। কষের ভেতর সম্পর্ক শুয়ে থাকার প্রকৃত অর্থ আমি বুঝিনি।

কিংবা  ‘দেখেছি নদী ও জলের শুধু ভাতঘুম আছে। (রোবটকাল)। ‘নদী ও জলের ভাতঘুম’ কি, তা-ও উপলব্ধি করতে পারিনি সেভাবে। পড়েছি এবং পড়ছি। ভালোলাগা অনেক কিছুরই যথাযথ অর্থ আমি পাইনি। এমন যথাযথ অর্থ না পাওয়া কবিতা বা কবিতার পঙক্তি কবি ও পাঠকের দূরত্ব তৈরির অনেক কারণের একটি। কবির রচিত কাব্যের বিশ্লেষণে পাঠক ব্যর্থ হয়ে অর্থ উদ্ধারে কবিমুখী গমনই দুর্বোধ্যতা। এ থেকে যে কবি যত বেশী মুক্ত থাকবেন তত বেশী পাঠকপ্রিয়তা তার ভাগ্যে জুটবে। নতুবা শিল্পে শ্রেষ্ঠ প্রতীয়মান হলেও ক্ষেত্র বিশেষে তা হয়ে যাবে গবেষকের প্রধান খোরাক। কবিতার পাঠক হবে অন্য আরেক কবি এই অবস্থা থেকে বাংলা কবিতার মুক্তি এখন সময়ের দাবী। এতে কবিতা হবে পাঠক নন্দিত, কবিতার হবে কল্যাণ।
নয়ন আহমেদের কবিতার জগতে বিচরণ করতে হলে তার পাঠককেও এক সময় ভাবে বোধে কাব্যরসে নিজেকে শাণিত করে তুলতে হয়। নতুবা কবিতা থেকে যায় পাঠকের অধরা। এটি আমাদের ধারনায় ক্লাসিক কবির অন্যতম গুণ, কিন্তু জনপ্রিয় বা সর্বসাধারণের  প্রিয় কবি হওয়ার ব্যাপক অন্তরায়। আমরা আমাদের কথার যথার্থতা খুঁজে পাই—
‘যখন তুমি বললে, ভালবাসি-
 তখন আমার কাঁপলো দুটি চোখ
... যখন তুমি হলে শুধু আমার 
একটি বাড়ি একটি শিল্পখামার। (যখন)
এটি একজন সাধারণ বাংলাভাষীর হৃদয়ে সহজে দোলা দেয়ার মতো পঙক্তি। আমজনতা এই পঙক্তিকে অতি সহজে আপন ভাবনার সাথে মিলিয়ে নেবে এক লহমায়।
‘একটু আগে জীবিত ছিলো একপাল আর্তনাদ; এখন নেই।
ছিলো গতিশীল, দুর্গন্ধবহ অহম; এখন মৃত। (একটু আগে)
অথবা 
‘জীবিতদের জন্য এসেছিলো আকুতি বোঝাই ইস্টিমার। 
গতি ও গন্তব্য
দূর ও দৌড়
অশ্ব ও আশ্বাস 
প্রেরক ও প্রাপক
ছুটে এসেছিল মানুষের কাছে। (জীবিতদের জন্য)
এই সব কবিতার অন্তর্নিহিত মর্ম উদ্ধারের জন্য পাঠককেও হতে হয় ভাবুক এবং ঘর পাততে হয় পাঠককে কবিতার সাথেই। এ কথা নিঃসন্দেহে সত্য, সস্তা জনপ্রিয়তার থেকে শক্তিমান কবিগণ সৃজন নির্মাণে প্রাগ্রসর হওয়াই অধিক কাম্য। নয়ন আহমেদের নির্মাণ কৌশলও সে পথেই ধাবিত। আমাদের বিশ্বাস তিনিও  সফলদের একজন।
তার সাফল্যকে স্পর্শ করতে সক্ষম হবে তারাই যারা বোধের গভীরে সাঁতার কাটেন অবিরত, তাদের অনুভবে ধরা দেবে— 
‘চায়ের টেবিলে, খাবার প্লেটে বিষ্যুদবার।
 ভাতের পাতিলে কী সুন্দর টগবগ করে ফুটছে বিষ্যুদবার! (বিষ্যুদবার)
বোধে বুদ হওয়া ছাড়া, কাব্যরসে সিক্ত হওয়া ছাড়া বিষ্যুদবারের মাহাত্ম বোঝার সাধ্য কি আছে কারো?  কবিতার একনিষ্ঠ পাঠকই বুঝে যান 
‘আজ ভালোবাসা কিংবা একটা ঘন লাল বিষ্যুদবার’। (বিষ্যুদবার)
 সাধারণ পাঠক স্পর্শ করতে ব্যর্থ হন বিষ্যুদবারের এত এত জৌলুস।
কবি নয়ন আহমেদ রূপকে সিদ্ধহস্ত। কবিতা রচনায় রূপকাশ্রয় তার প্রধান কাব্য কৌশল, চিন্তা বা কল্পনাশক্তিতেও ঈর্ষণীয় মেধাবী। তার কল্পনার জগৎ অসম্ভব রকমের বিস্তৃত। তিনি যদি কবিতা না লিখতেন তবে?  তবে তার বয়ানেই শুনি—  
‘কবিতা না লিখলে, এই পথটাকে আমি কোলে নিয়ে বসে থাকবো’।
...তারপর তিনি আপন কল্পনায় সংযোজন করেন 
পথের শক্ত দুটো হাত
পথের দৃঢ় দুটি পা
পথের হৃদপিন্ডের সমবয়সী দুটি চোখ
আর সূর্যমুখীর মতো মুখমন্ডল আমার অস্তিত্বে জায়গা দখল করেছে। (কবিতা না লিখলে)
ভিক্ষুকের পায়ে লক্ষ্মী, আর সৈনিক তার পায়ে খোঁজে প্রথম ছন্দের তাল লেফট রাইট-লেফট রাইট। পা এগিয়ে চলার বা সামনে চলার অন্যতম অবলম্বন। কাজেই কবি পা’কে গ্রহণ করেছেন তার কবিতার রূপকের মাধ্যম।
পা মানেই তার অস্তিত্বে প্রাণ, প্রাণীর শরীরের অপরিহার্য অঙ্গ পা। মূলত এখানে প্রাণী নয় মানুষই উদ্দেশ্য। এ কথার বিশ্লেষণের প্রয়োজন পড়ে না যখন কবিতায় দেখি—   
কোন কোন পা আলতায় সেজেছে; 
শিল্প হতে ইচ্ছুক 
অথবা 
কিছু কিছু পায়ের আদল বিপ্লব বিপ্লব বলে বহুবার 
জীবনের সন্নিকটে গেছে 
জগতের মানুষ আর কবিতার পায়েরা বিচিত্ররূপি, বহু স্বভাবে তাদের বিচরণ। কেউ থেকে যায় আজীবন বাড়ির উঠোনে, কেউ আলতায় রাঙিয়ে জীবন চালিয়ে দেয়, কেউ স্থবির হয়ে আছে অনাদিকাল, কেউ কেউ কোন দিন পথের দূুরত্বটাই মেপে দেখেনি। তাদের সকলকে লক্ষ করে কবির আহবান 
আলতাপরা পা, ভাঙাচোরা পা,
যন্ত্রণাক্লিষ্ট পা, বাতগ্রস্ত পা,
জাগর ও জাগৃতির কাঁধে নিয়ে এবার বেড়িয়ে পড়ো একযোগে। (পায়ের সন্নিকটে)
নয়ন আহমেদ কবি, কবিতাকে কবিতা করে তোলাই তার সাধনা। মানুষকে আহবান করতে পায়ের বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। পায়ের সন্নিকটে নির্মাণ করেছেন কবিতার পঙক্তি। এভাবেই এগিয়ে চলেছেন আরো সামনের গন্তব্যে। গন্তব্য পৌঁছতে তার একটু বিলম্ব হবে। চলতি পথে তিনি মানুষের জিহ্বাকে প্রসারণ করে কুহক সরাবেন, কুয়াশার বুক বিদীর্ণ করে অনাগত দিনের বুকে মাদুর বিছাবেন, তারপর তিনি গভীর দরজা খুলবেন, তারপর তিনি তার গন্তব্যে আসবেন। 
এটা কেউ দেখুক বা না দেখুক
কেউ শাদা স্থাপত্যের শব্দ শুনুক বা না শুনুক
আমি নিজেকেই রোপন করে দিয়েছি মাটিতে
আমার আরও একটু বিলম্ব হবে। (বিলম্ব) 

কবির চোখ বর্ণিল চিত্র দেখতে অভ্যস্ত, কবির বোধ গভীর ভাবনায় নিমজ্জিত। তাই সাধারণের দর্শন আর কবির দর্শনে বিস্তর ফারাক। সাধারণের চোখে সূর্য অস্তমিতই হল রাত। আঁধার অথবা জোছনার খেলাই হল রাত। এ ছাড়াও যে রাতের বহুবর্ণিল দৃশ্য আছে তা কেবল ধরা দেয় গভীর ভাবনা আর প্রখর কল্পনামিশ্রিত কবির তৃতীয় চোখে। কবি চোখের কর্নিয়ায় ভেসে ওঠে—
চুলের মতো মসৃণ রাত্রি 
বট পাতার মতো চ্যাপ্টা রাত্রি
চায়ের লিকারের মতো রাত্রি
হাতের মতো বহুবর্ণিল রাত্রি
বর্ণমালার মতো পূর্ণ রাত্রি
একটা মেয়ের চোখের মতো দৃষ্টিপ্রসারী রাত্রি
লাউয়ের পাতার মতো বিনীত রাত্রি
উপনিবেশমুক্ত শান্ত রাত্রি। (শুভ রাত্রি)

রাজনীতির কালো মেঘ দলে, মতে,  ব্যক্তিতে, গোষ্ঠীতে যে বিভেদ তৈরি করেছে তার দেয়াল অন্তত বাংলাদেশের আবহে মুছে ফেলা প্রায় অসম্ভব। তাই দেখা যায় সর্বজন স্বীকৃত বিষয়েও মতবিরোধ কেবল রাজনৈতিক মতবিরোধের স্বার্থেই। এই বিরোধ নিষ্পত্তিতে এগিয়ে আসতে পারেন একজন কবি। কবি তার মুন্সিয়ানায় জানিয়ে দেন স্মরণীয় বরণীয় কোন দল বা গোষ্ঠীর একক কেউ নন। বরং তারা সবার প্রিয়, সবার শ্রদ্ধেয়। নয়ন আহমেদ লিখেন— 
উড়ছে হাজার হাজার পাখি গান নিয়ে; শুভেচ্ছা নিও
 ১৯৭১, প্রিয়তমা আমার; শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা নিও। (১৯৭১) 

‘এককাপ গণযোগাযোগ ’ কবি নয়ন আহমেদের কবিতার বইটি প্রকাশকাল বইমেলা ২০১৮।
প্রচ্ছদ এঁকেছেন সাইফ আলি
প্রকাশক ইনভেলাপ পাবলিকেশন্স
মূল্য ১২০ টাকা।

পাঠকের মন্তব্য Login Registration