লোকসংগীতের বাহিরানা

প্রতিনিধি | সমালোচনা

রবিবার ৩ ফেব্রুয়ারী ২০১৯|১৯:২৮:২৮ মি.



ইকবাল হায়দার

সব আওয়াজই শেষ পর্যন্ত গান বা সংগীত। প্রয়াত কবি, বংশীবাদক, নাট্যকার, গল্পকার ও অসংখ্য রাগভিত্তিক গানের স্রষ্টা একুশে পদক প্রাপ্ত শিল্পী সুচরিত চৌধুরী তাঁর সংগীত ভাবনা প্রবন্ধে বলেন, “সংগীত কলার দুই জগৎ এক আধ্যাত্মিক অন্যটি জীবন ভিত্তিক। আধ্যাত্মিক গান দরবারের দ্রুপদী আর জীবন ভিত্তিক গান হল জীবন নিংড়ে নেয়া লোক সংগীত”- সংগীত একধরনের শ্রবণ যোগ্য কলা যা সুসংবদ্ধ শব্দ নৈঃশব্দের সমন্বয়ে মানব চিত্তে আনন্দ দেয়। স্বর ও ধ্বনিই সংগীতের মূল ধারা। যা মানব কণ্ঠে নিঃসৃত তাহাই স্বর আর যন্ত্রোৎপাদিত শব্দ হচ্ছে ধ্বনি। সুর হচ্ছে ধ্বনির প্রধান বাহন। তাল সংগীতের নিয়ামক। কথা, সুর, কণ্ঠ, যন্ত্র এই ত্রিমাত্রিক প্রক্রিয়া কথাকে গান করে তোলে।
প্রথম সংগীতের অস্তিত্ব অন্তত পঞ্চান্ন হাজার বছর আগে সম্ভাব্য ভাবে আবিষ্কৃত হয়েছিল আফ্রিকায় এবং তখন থেকে নানা বিবর্তন ঘটতে ঘটতে এটা একটা মৌলিক নিয়োজক হয়ে ক্রমে মানুষের জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একটা সংস্কৃতির সংগীত সমাজের অন্যান্য সংস্কৃতির দৃষ্টি ভঙ্গির যেমন সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্থা, অভিজ্ঞতা, তেমনি আবহাওয়ার কারিগরীর ব্যবহারও এই সকল বিষয় দ্বারা প্রভাবিত। সংগীত আবেগ ও ধারনা পরিব্যক্ত করে। যে পরিস্থিতিতে সংগীত গাওয়া ও শোনা হয় এবং যে ভঙ্গিমায় সংগীতকাররা উপস্থাপনা করেন তার সবটাই অঞ্চল এবং সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তারতম্য ঘটায়।
বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে বাঙালির আত্ম-পরিচয়ের এক নয়া মেনিফেস্টো রচনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বাউল আবিষ্কারের মাধ্যমে। বাউল গান হল সেই সাংস্কৃতিক তৎপরতার নাম যেখানে বাউলিয়ানা ও বাঙালিয়ানা প্রায় সমার্থক হয়ে উঠেছিল। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে উৎস হিসেবে উচ্চাঙ্গ সংগীত এবং লোক সংগীত দুই ব্যবহার করেছিলেন।
আমরা জীবন নিংড়ে নেয়া লোক সংগীতের ঘরানা-বাহিরানা নিয়ে কিছু বিষয়ের অবতারণা করব, যার সঙ্গে বাঙালিয়ানা ও বাউলিয়ানার সম্পর্ক নিবিড়। যেহেতু লোক সংগীতের বিপুল খনি বাংলাদেশ এবং অঞ্চল, সম্প্রদায়ে, জাতি গোষ্ঠীতে তা ভিন্নতা পেয়েছে তেমনি লোক সংগীতের ভাণ্ডার কবি গান, গম্ভীরা, জারি গান, সারি গান, বাউল গান, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালী, মুর্শিদী, পল্লীগীতি, আধ্যাত্মিক গান, মরমী, বিচ্ছেদি, মাইজভাণ্ডারী, দেহতত্ত্ব, অহীরা গান, আলকাপ, কৃষাণ গান, গাজির গান, ঘেটু গান, ছেচঁর গান, জাওয়া গান, জাগ গান, ঝুমুর গান, ঝাপান, টুসু গান, তরজা গান, ধামাইল গান, ধুয়া গান, পটুয়ার গান, পটু গান, পাচালীর গান, পালা গান, বারোমাইশা গান, ভাজোর গান, ভাদু গান, ভাসাণ গান, লেটো গান, শিলারীর গান, হ্যাপু গান, হাদুমা গান, হোল বোল, হোলী গান ইত্যাদি বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক বাহক হয়ে কালক্রমে মানুষের তথা এতদঞ্চলের জনগোষ্ঠীর অন্তরে নিগুঢ় প্রভাব ফেলেছে।
ঘর থেকে ঘরানা শব্দের উৎপত্তি। প্রতিটি ঘরানা নিজস্ব বৈশিষ্ট্যেসমুজ্জল। বন্ধিশে, রীতিপ্রকরণে, গায়নভঙিমায় পৃথক অথচ দশ ঠাটের অন্তর্গত থেকে তার অগ্রগমন। শিল্প ভাবনার পরিণতির দিকে লক্ষ্য রেখে মধুর শৃঙ্খলা পরায়নতায় ঘরানার বিস্তার ঘটে।
শাস্ত্রীয় সংগীত গুরুমুখী। গুরুর প্রশিক্ষণে ঘরানার শুদ্ধতা বজায় থাকে। উত্তর সাধক রূপে ঘরানার পারস্পর্য্যে সন্তান বা নিকট জনের স্থান ছিল শীর্ষে।শিল্পী পরম্পরায় ঘরানা রক্ষার ধারাটি ছিল অব্যাহত। শাস্ত্রীয় শৈলীতে আবদ্ধ কণ্ঠ ও যন্ত্র বাদনকে শক্ত নিয়মানুবর্তিতার মধ্য দিয়ে চলতে হয়।
রাজন্য বর্গের আনুকুল্যে বা পৃষ্ঠপোষকতায়, ভোগবাদীদের চিত্তবিনোদনের কারণে রাজ সভায় উস্তাদদের ভরনপোষন, সম্মানজনক মাসোহারা, সপরিবারে আবাসগৃহে থাকার সু-বন্দোবস্ত রাজন্য বর্গরা করতেন বিধায় শাস্ত্রীয় সংগীত সর্বসাধারণের কাছ থেকে বহু দূরে রেখেছে। ।
প্রখ্যাত লোক ও গণসংগীত শিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাস বলেন, “ঘরানা বিষয়টি ঘরে সীমাবদ্ধ। লোক সংগীতে আছে বাহিরানা সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত”। গানের ঘরানার বিপরীতে ‘বাহিরানা’ নামে একটি ধারনার প্রস্তাব করেছিলেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস, বাংলার লোকসংগীত প্রসঙ্গে।ঘরানা বলতে কোনো সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অন্তর্মুখী চলাচলের ধারনা বোঝানো হয়; আর হেমাঙ্গ-কথিত বাহিরানা মূলত কোনো সাংস্কৃতিক চর্চার বহির্মুখী প্রসারের কথা বলে। বাউলগানের ক্রমবর্ধমান বৈচিত্র্যকে বোঝার জন্য তাকে ঘরানা নয়, বরং বাহিরানা আকারে দেখা দরকার। এই বাহিরানা ক্রিয়াশীল আছে বলেই বাউলিয়ানার চর্চা আজও বাঙালিয়ানার নানান পরিসরে বিস্তৃত হয়ে চলেছে।
লোক সংগীতের বাউল গানে আমরা যে জীবনাচরণ ও পরিবেশ দেখি তাতে বাঙালিয়ানা যোগ ছিল খণ্ডিত। বাংলাকে প্রতিনিধিত্ব করার কোন ইচ্ছা বাউল সাধক লালনের ছিল না বা জাতীয়তাবাদের কোন সাক্ষ্য তাঁর লেখায় পাওয়া যায় নি বরং তা ছিল একটি গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ দর্শন চর্চা, ছিল ধর্মতাত্ত্বিক প্রশ্ন। সংগীত ছিল তাঁর ভাবনা প্রকাশের হাতিয়ার। পরবর্তীতে শাহ আব্দুল করিম বাঙালিয়ানা ও বাউলিয়ানার মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত যোগাযোগ তৈরি করেন, ফলে শাহ আব্দুল করিম বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আইকন হয়ে উঠেন। তিনি বাউলশিল্পী। অবশ্যই তাঁর বাউলিয়ানা ছেঁউড়িয়ার অর্থোডক্স বাউলিয়ানা থেকে ভিন্ন ধাচেঁর। অর্থোডক্স বাউল যেখানে তাঁর ধর্মচর্চার অংশ হিসেব সংগীত চর্চা করেন, শাহ আব্দুল করিম সেখানে গানের দুতিয়ালিতে বাউল ধর্মে দীক্ষিত হয়েছেন। ফলে স্বভাবতই তাঁর বাউলিয়ানা খানিকটা ঢিলেঢালা, সংগীতশাসিত। কিন্তু এটি শুধু তাঁর একার ক্ষেত্রেই ঘটেছে এমন নয়। হাছন রাজা, উকিল মুন্সী, রাধারমণ সহ আরও বহু সংগীতকার এই ধরনের বাউলিয়ানার চর্চা করেছেন। তাদের সবারই লোকগানের জমিন বিস্তীর্ণ, সংগীতের নানা রীতি, যেখানে তাদের লোকগানের চর্চার ভেতর মিশে গেছে, শাহ আবদুল করিমের ক্ষেত্রে সেটি আরও বিস্তৃত। তিনি গানের জগতে নিজেকে দাঁড় করিয়েছেন লোকগান ও বাউল গানের ঠিক মাঝখানে। শাহ আবদুল করিমের যেই বাঙালিয়ানার পরিচয় পাওয়া গেল, বাউলিয়ানা তাঁর স্বতঃস্ফূর্ত অংশ। শাহ আবদুল করিম কে যে বাউল ঘরানার শিল্পী বলা হয় সে বাউলিয়ানায় তাকে ঘরানার ঘেরাটোপে আটকানো কঠিন।
লোকগানের ঐতিহ্যে ঘরানা মানানসই কোনো প্রস্তাব নয়। বরং শাস্ত্রীয় সংগীত ঘরানা নির্ভর।তার সেই ঘরানা তৈরি হয় ওই বিশেষ সংগীতের কথা, সুর কিংবা গায়কী- এমনকি শিল্পীদের বেড়ে ওঠা, জীবনাচরণ এবং শ্রোতামণ্ডলীর বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি বিবেচনায়। শাস্ত্রীয় সংগীতের যেহেতু শুদ্ধতার অভিমান আছে, সেহেতু সাংগীতিক পরিসরে তার মেলামেশা খুবই দাপ্তরিক। লোকসংগীতের এহেন শুদ্ধতার অভিমান নেই। মেলা মেশা যতই হোক, লোকগান মূলত অঞ্চলভিত্তিক। ভৌগোলিক চারিত্র মেনে চলে। এটাই বাহিরানা, হেমাঙ্গ বিশ্বাসের ভাষায়। বাউল দর্শন চর্চার অংশ হিসেবে বাউলসংগীতের যে চর্চা আমরা লালনে দেখি, বাউলের গোষ্ঠীবদ্ধতার কারণে একে ঘরানা ভাবায় দোষ দেখি না।কিন্তু পরবর্তী বছরগুলোতে ইত্যাকার লোকগানের চর্চার মধ্য দিয়ে বাঊলের ভাব ধারা যে ভাবে বয়ে গেছে, তাতে বাউলকে আর গানের একক কোনো ঘরানা রূপে শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না।বাউল গান পরিণত হয়েছে বাহিরানায়।
হেমাঙ্গ বিশ্বাস বলেন, “লোকসংগীত গুরুমুখী নয়- গণমুখী। লোক সংগীতের কোন ঘরানা নেই, আছে বাহিরানা।এই আঞ্চলিকতাকেই আমি বাহিরানা বলছি। কোনো অঞ্চলের গান গাইতে গেলে সেই জীবনের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য প্রয়োজন। প্রত্যেক সার্থক লোকসংগীতে শিল্পীর গান গাওয়ার সাথে সাথে তার মনে ভেসে উঠে একটা ারংঁধষ রসধমব বা চাক্ষুস চিত্র। কোনো মার্গ সঙ্গীত শিল্পী যখন টোড়ী রাগে আলাপ করেন তখন তাঁর চোখের সামনে উদার বক্ষযুক্ত সর্পাকৃতি দুইটি অলকের অধিকারিনী সুরাকৃষ্ট বনের হরিণবেষ্টিতা বীণাবাদনরতা এক সুন্দরী বিরহিনী ভামিনী’র ছবি ভেসে ওঠে কিনা জানি না, উঠলেও এই বিমূর্ত ছবি টি কেবল গায়ক বিশেষের চোখেই থাকে।কিন্তু ভাটিয়ালি বা ভাওয়াইয়া সুরের সত্যিকারের শিল্পী যখন সুরে টান দেন তখন তাঁর মানসচক্ষে যে জনপদের, যে প্রকৃতি ও প্রান্তরের ছবি ভেসে ওঠে তা সুস্পষ্ট এবং তাঁর পড়সসঁহরপধঃরড়হ বা ভাবানুষঙ্গটিও সর্বজনীন। সেখানে ‘রঙিলা নায়ের মাঝি’, মৈশাল বন্ধু’ বা ‘গড়িয়াল ভাই’ কথাগুলো না থাকলেও চলে, শুধু সুরের মধ্যে যে ধংংড়পরধঃরড়হ বা অনুসঙ্গ তার অনুভূতি সর্বজনীন। সেখানে যে আর্তি, তাতে পাই শ্রমজীবী মানুষের একটানা বঞ্চনার অভিব্যক্তি। সেখানে মিশে থাকে ঘাম এবং কান্না, আবার জীবনের অসীম আকুতি ও আশাবাদ।সাংস্কৃতিক চর্চা হিসেবে বাউলগান আখড়ার গণ্ডির বাইরে চলে এসেছে বহুকাল আগেই। সেটা ঘটেছে খোদ লালন শাহর জীবদ্দশায়। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাউল গানের কথা পাল্টে যায় বা যুগোপযোগী হয়ে ওঠে। এই যে ক্রমাগত যুগোপযোগী হয়ে উঠার বাসনা, এটাই কিন্তু বাউল গানের লোকপ্রিয়তার মূলমন্ত্র এবং এই চর্চার বেশির ভাগ টুকুই ঘটে আখড়া বা ছেঁউড়িয়ার বাইরে”।
সুর ও কথায় লোকসংগীত বা শেকড় সন্ধান একটি বড় প্রবণতা।কিন্তু এই লোক সংগীত আশ্রয়ে যে ধারাটি সবচাইতে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছে সেটি হল মৃত্যুর ধারা, জীবনের নয়। কেন মৃত্যু, আত্ম-সমর্পণ আর হতাশা কিংবা ব্যক্তি বিচ্ছিন্নতার কথা ও সুর জনপ্রিয় গানের মূল ধারা তৈরি করে?
লোকসংগীতে সাধারণভাবে নারী, নিপীড়িত মানুষ, সংখ্যালঘু মানুষের গানে কথায় যে ব্যক্তিক অনুভূতি প্রকাশিত হয় তাতে এই জগতে তাঁদের জীবন সংগ্রামের ক্ষোভ, হতাশা আর বেদনার ছাপ পাওয়া যায়।
লোকসংগীতে গায়কীটা জল, মাটি, হাওয়ার কিংবা পাহাড় ও উপত্যকার। গুরু একজন নয়- গণসমষ্টি। সুরের লহরে তুলিতে আঁকা সামগ্রিক সমষ্টিজীবনের চিত্রপট থাকে চোখের সামনে। একটি বাদ দিয়ে আরেকটি উপলব্ধি করা যায় না। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মতে, (অখণ্ড) বাংলাদেশের পূর্ববঙ্গের মূল মেলোডি হলো ভাটিয়ালি, উত্তরবঙ্গের তেমনি ভাওয়াইয়া, মধ্যবঙ্গের মূল গীতরীতি হলো বাউল।
হেমাঙ্গ বিশ্বাসের ভাষায়, ‘লোকসংগীত শুধু অতীত সন্ধানী নয়, লোকসংগীত বর্তমান ও ভবিষ্যতের প্রতিষ্ঠান। সেজন্য লোকসংগীত বা নির্দিষ্ট অঞ্চলে পরম্পরায় টিকে থাকা ভাব, ভাষা ও অভিব্যক্তির উপর অন্য সংগীতের মূল স্রোত তৈরি হয়।’
জীবনের প্রবহমান ধারাতেই গান জন্ম নেয়। জীবনের শ্রম, ঘাম, দাম সব থেকে সৃষ্টি হতে পারে গান। যে জীবনের গানের উৎস লোকসংগীত সেই জীবনের বিশেষ বিশেষ মুহূর্তকে বিশিষ্ট করে তোলে। ব্যক্তির ক্রোধ, ক্ষোভ, আর্তনাদ, প্রেম ,প্রতিবাদ, স্বপ্ন আর লড়াই কে সমষ্টির সঙ্গে যুক্ত করে। সব দেশেই লোকসংগীতে মানুষের প্রাণের টান থাকে, থাকে শেকড়ের যোগ।
উপমহাদেশের কৃষক-কারিগর- জলজীবি,-মরুজীবি সমাজ মর্মের সাধন আর মনের বেদন প্রকাশে যে সংগীতের চর্চা শত শত বছর যাবত হয়ে আসছে, তা ‘অতীত নয়’, ‘ঐতিহ্য নয়’ এবং মৃত বা বিলুপ্ত তো নয়ই। ভাওয়াইয়া-ভাটিয়ালি, জারি-সারি, বয়াতি- মরমী গান ও পালার অতীত আছে, বর্তমান আছে, ভবিষ্যৎ আছে।
ভাওয়াইয়া থেকে ভাটিয়ালি, লালনগীতি থেকে মাইজভাণ্ডারী, জালাল উদ্দিন খাঁ থেকে উকিল মুন্সি, রামকানাই দাশ থেকে বাউল আবদুল করিম, মাতাল রাজ্জাক থেকে মালেক দেওয়ান, কাঙালিনী সুফিয়া থেকে কুদ্দুস বয়াতির গাওয়া গানই লোকগীতি বা পল্লিগীতি। এক সময় দেশ জোড়া যত নদী তত রকমের গানের জীবন্ত ধারা ছিল। বাউল সাধনার চর্চা ছাড়া বাউল গান যেমন হয় না, সুফিবোধ ছাড়া তেমনি হয় না সুফিগান। উত্তরের রুক্ষ পরিবেশ ছাড়া জাগে না ভাওয়াইয়া, পূবালি বাতাস ছাড়া হয় না হাওড়ের গান। গান তখন লেখা হত না বান্ধা হত।আর বান্ধার কাজটা একক অথরশিপের ব্যাপার ছিল না, বহু লোকশিল্পীর ভাব ও কল্পনার মিশেল তাতে অবারিত ছিল।
আমরা জানি, শচীনকত্তার সুরের ভুবন কুমিল্লার নদী, মাটি ও মানুষ, ত্রিপুরার, ধানের ক্ষেতে চাষি গান গাইতে গাইতে ধান চাষ করে, মাঝিরা গানের টান না দিয়ে নৌকা চালাতে পারে না, জেলেরা গান গেয়ে মাছ ধরে, দিঘীর ধারে ঘুরে ঘুরে টিপরাই বাঁশি বাজিয়ে যাচ্ছেন, গাছ পালা খেত খামার খোলা আকাশের নিচে গান বাজনার আনন্দটাকে চিরকাল হৃদয়ে স্মৃতির পটে ধরে রেখেছেন এই মহান শিল্পী।
‘গলার গঠনের একটা বাস্তব ভিত্তি আছে। তা শ্রমপ্রক্রিয়াগত, সামাজিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশে জলমাটি হাওয়াজাত কতকটা জাতি বা গোষ্ঠীগত কতকটা শারীরিকগত কতকটা বাকভঙ্গিগত’। গলা ভাঙ্গা, গলার খোঁচ বা লৌকিক অলংকার কোনও শহুরে ওস্তাদ হাজার রেওয়াজ করেও আয়ত্তে আনতে পারে না।শহুরে কণ্ঠ লোকসংগীতের মেলডিক স্ট্রাকচারটা ঠিকই আয়ত্ত করতে পারেন কিন্তু কণ্ঠ ভঙ্গিটি আয়ত্ত করতে পারেন না। তাতে করে সেই গানে মাটির গন্ধটি পাওয়া যায় না, বড়ই শহুরে মনে হয়। লোকসংগীত গুরুমুখী নয়, গণমুখী, ঘরানা নেই, আছে বাহিরানা।
আমাদের গবেষণায়, নিরীক্ষায়, অনুসন্ধানে এটাই স্পষ্ট প্রতীয়মান যে, নদী, খাল, প্রকৃতি, মানুষ তার সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, বিচ্ছেদ, বেদন, নদী, সাগরের জোয়ার ভাটা, পাকপাখালির কণ্ঠে গানের যে সুর, যে আর্তি, যে বিরহের ছোপ, তা একমাত্র লোকসংগীতে ব্যাপৃত। বাতাসে, বৃষ্টিতে, ঢেউয়ের তালে, সবুজের গাঢ়তায়, রোদে, ঝড়ে, পাহাড়ে, মেঘে, ধূলার পথে তা আরও পরিব্যপ্ত এটাই লোকসংগীতের বাহিরানা। এখানে দেয়াল নেই, সীমা নেই, নিয়ন্ত্রণ নেই অবারিত কণ্ঠে শুধুই গেয়ে যাওয়া।
তথ্যপঞ্জি ও যে সকল গ্রন্থের সহায়তা নেয়া হয়েছে :

সংগীতের সামাজিক ইতিহাস, সম্পাদক স্বপন দেশাধিকারী এর অন্তর্গত ‘সংগীত বাংলা সামাজিক প্রেক্ষাপট ’ লেখক দ্বীনেন্দ্র চৌধুরী, প্রকাশক দীলিপ চক্রবর্তী, অধুনা জনার্ক পরিষদ, কোলকাতা।
আধ্যাত্মিক সাধনায় সংগীত, ওস্তাদ মোবারক হোসেন খান।
“বাংলার বাউল ফকির” সুধীর চক্রবর্তী সম্পাদিত, প্রকাশক- পুস্তক বিপনী, ২৭ বেনিয়াটোলা লেইন, কোলকাতা।
সংসদ বাংলা অভিধান সম্পাদক শ্রী শৈলেন্দ্র বিশ্বাস ১৩৭৮ সন বেল গড়িয়া কোলকাতা।
শাহ আবদুল করিম, জীবন ও গান, সুমন কুমার দাশ, প্রথমা প্রকাশন ২০১৫।
শাহ আবদুল করিমের ঘরানা বাহিরানা ও বাউলিয়ানা, সুমন রহমান।
বাউল গানের ‘বাহিরানা’, সুমন রহমান।
হেমাঙ্গ বিশ্বাস ও গানের বাহিরানা (শেষ পর্ব)।

সূত্র- দৈনিক আজাদী

পাঠকের মন্তব্য Login Registration