সংগ্রাম, উৎপাদন ও উৎসবের সরলকাব্য

প্রতিনিধি | সমালোচনা

বৃহস্পতিবার ২৬ জুলাই ২০১৮|১৮:২১:২৪ মি.



মলয় বালা: জীবনধারণের মৌলিক চাহিদার সবক’টি উপাদানই প্রকৃতির মধ্যে রয়েছে। তাই মানুষকে জীবনধারণ করতে হয় প্রকৃতির সঙ্গে নীরব সংগ্রাম করে। কখনো অনুকূল পরিবেশ খুঁজে নেয়ার সংগ্রাম, কখনো প্রতিকূল পরিবেশের বিপক্ষে সংগ্রাম, কখনোবা কৃষিজ উৎপাদনের জন্য সংগ্রাম। এই সংগ্রামের মধ্যে রয়েছে সৃষ্টিতত্ত্বের নানা অনুষঙ্গ।

যে প্রকৃতি রুদ্র, রুক্ষ সে-ই আবার বহুবর্ণিল সৌন্দর্যের মায়াবী আবাসস্থল। সেজন্য এই সংগ্রামের প্রতিটি স্তরে রয়েছে আনন্দ ও বেদনাগাঁথা। বেঁচে থাকার তাগিদের পাশাপাশি চলে মনোজাগতিক আনন্দ উদযাপনের বাসনা। এই বাসনা চরিতার্থ হয় উৎসব ও কৃষ্টিতে। প্রকৃতির রং বদলের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এরূপ নানাবিধ উৎসব উদযাপনের প্রথা রয়েছে আদিবাসী সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে। কৃষিজ উৎপাদনের পার্ব-পর্বান্তরে এসব উৎসব ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূ-প্রকৃতি ও সাঁওতালদের জীবনযাপনের বর্ণিল স্মৃতিচারণ রয়েছে সুমন কুমার সরকারের চিত্রমালায়। শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিবিজড়িত বরেন্দ্রভূমি তার মনোভূমিতে বিস্তর জায়গা দখল করে আছে। কর্মসূত্রে সুমন ‘রাজউক’-এর নগর পরিকল্পনা বিভাগের শিল্পী। নগরের সৌন্দর্য পরিকল্পনা করাই তার কাজ। ইট-পাথরের আবাস সৌন্দর্যের পরিকল্পনার বাইরে নিসর্গবেষ্টিত গেরুয়া মাটি ও মানুষের বরেন্দ্রভূমির রূপ পরিবর্তন তাকে ব্যথিত করে। তাই স্মৃতি-রোমন্থন আর প্রত্যক্ষণবোধের হিসেব-নিকেশ মিলিয়ে এঁকে চলেন বরেন্দ্র অঞ্চলের মাটি ও মানুষের সরল জীবনাচারণ কাব্য।

নগরায়নের নানা উপসর্গের পরিবর্তন হচ্ছে বরেন্দ্র ভূমিরূপ ও সংস্কৃতি। তেমনি ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও বেঁচে থাকার প্রয়োজনে আদিবাসীদের ধর্মান্তরিত হওয়া এবং ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন কৃষ্টি ও সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা বিলোপ হওয়া সুমনকে ব্যাথিত করে। এ জন্যই স্মৃতিধৃত বরেন্দ্রকাব্য তিনি রঙে সাজান একান্ত সরল করে। পক্ষান্তরে তার চিত্রকর্মে বিষয়ের ময়নাতদন্ত নেই, আছে সরল উপস্থাপন। অনেকটা স্থানিক ডকুমেন্টেশন বলা যায়। অর্থাৎ দৃষ্টি সীমায় যা দৃশ্যত নয় তার বাইরে কোনো ইঙ্গিত দিতে চান না। স্বভাবে শান্ত সুমনের মনোভূমিতে নদী প্রবাহের মতো প্রতিবাদ ও সময় সচেতনতার বোধ খেলা করে। তার চেতনা জাগ্রত থাকে সময় ও প্রকৃতি পরিবর্তনের নীরব বেদনা উপলব্ধিতে।

কাজগুলো প্রাতিষ্ঠানিক অঙ্কনশৈলী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ক্যামেরাবন্দি কম্পোজিশন। তবে রং ব্যবহারে রয়েছে মুন্সিয়ানা। বরেন্দ্রভূমির স্থানিক বৈশিষ্ট্য জানান, দেওয়াই যেন মূল লক্ষ। চিত্রে ব্যবহৃত বস্তু উপাদান খোলাসা করে অর্থাৎ কাছে থেকে দেখার প্রবৃত্তি কম। অর্থাৎ স্মৃতিচারণের মতো শিল্পী যেন নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে অবলোকন করছেন তার ফেলে আসা সময়কে। একটা স্বপ্নঘোরের মাঝে ধোঁয়াশা বা ঝাপসা করে দেখা। মানুষকে প্রকৃতির বিশালত্বের সঙ্গে একাত্ম করে দেখেছেন তিনি। ফলে ভূমিচিত্রের মধ্যস্থ মানুষ কখনো মুখ্য হয়ে ওঠেনি। সমান গুরুত্ব পেয়েছে নদী, ঘাট, কৃষিজমি, সাঁওতাল পাড়ার আনাচ-কানাচ, সারিবদ্ধ নৌকা প্রভৃতি যেখানে কৃষি জীবনের প্রতিবেশ বিধৃত হয়েছে।

‘বরেন্দ্রের প্রান্তর’ চিত্রে অনাবাদী বিস্তীর্ণ জমি ও উঁচুনিচু লালমাটির মধ্যে গবাদি পশুর ঘাস খাওয়ার দৃশ্য তিনি সুনিপুণভাবে এঁকেছেন রৌদ্রালোকিত তপ্ত দুপুরের বর্ণচ্ছটা হলুদ রঙের আধিক্যে। ‘পারাপার’ সিরিজচিত্রে নদী, নৌকা, বালুচর, নদীর ওপারের গ্রাম, পথযাত্রী যেন চিরচেনা বাংলার চালচিত্র। এই সিরিজের একটি চিত্রে দৃষ্টিসীমা ছড়িয়ে যাচ্ছে নদীর এপার থেকে ওপার পর্যন্ত। ঘরবাড়ি উঠানের নির্দিষ্ট ধরন লক্ষ্য করা যায় সাঁওতালপাড়া সিরিজচিত্রের কাজগুলোতে। ‘হেমন্তের উঠান’ চিত্রে পরম মমতায় উঠানের ধান বিছাচ্ছেন এক রমণী। এখানেও আশা, স্বপ্ন, উৎপাদন ও গৃহস্থালী কাজের সনাতনী পদ্ধতির তথ্যচিত্র উঠে এসেছে। অধিকাংশ কাজে গৃহপালিত পশু বিশেষত বরেন্দ্র অঞ্চলের মহিষ এবং কৃষিকাজের নানাবিধ উপকরণ সুরাপিত হয়েছে রং রেখার সরলকাব্যে।-মানবকণ্ঠ

পাঠকের মন্তব্য Login Registration