‘সুফি গান আমার কাছে ঈশ্বরবন্দনার মতো’

প্রতিনিধি | সমালোচনা

বুধবার ২৩ জানুয়ারী ২০১৯|১৪:৩৭:৫৮ মি.



'সঙ্গীতের আলাদা কোনো ভাষা নেই। কোনো মানচিত্রের মধ্যেও একে বন্দি করে রাখা যায় না। আমিও তাই কোনো নির্দিষ্ট ঘরানার শিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইনি। প্রতিনিয়ত সঙ্গীতের নানা ধরনের নিরীক্ষা করে গেছি। ভালো লাগাকে বিসর্জন দিয়ে খ্যাতি কুড়াতে চাইনি। ক্লাসিক্যাল থেকে শুরু করে সুফি, পপ, রক, ফিউশনসহ নানা ধরনের গান করেছি। কিন্তু যে ধরনের গানে নিজের মন সায় দেয়নি, তা কখনও করতে চাইনি। 

সেটাই করেছি, যা আমার শিল্পী সত্তাকে কিছুটা হলেও তৃপ্ত করেছে।' 

বললেন পাকিস্তানের নন্দিত কণ্ঠশিল্পী শাফকাত আমানত আলী। ঢাকা আর্মি স্টেডিয়ামে আয়োজিত 'ঢাকা আন্তর্জাতিক লোকউৎসবের শেষ রজনীতে সঙ্গীত পরিবেশন করবেন তিনি। উৎসবে অংশ নেওয়ার আগে তিনি ঢাকার একটি অভিজাত রেস্তোরাঁয় সমকালের সঙ্গে একান্ত আলাপে অংশ নেন। বলেন, 'শুধু দেশীয় ঐতিহ্য আর বংশপরম্পরা ধরে রাখতে সুফি গানকে প্রাধান্য দিয়েছি- বিষয়টি এমন নয়। নিজেও সুফি গানের অনুরাগী ছিলাম বরাবর। সুফি গান আমার কাছে ঈশ্বরবন্দনার মতো। আজকেও দর্শকের সামনে সুফি গানের কিছু নমুনা তুলে ধরতে চাই।' সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো : 

প্রশ্ন: এটাই কি প্রথম বাংলাদেশ সফর?

শাফকাত আমানত আলী : লোকসঙ্গীত উৎসবে এবারই প্রথম অংশ নিচ্ছি। কিন্তু এটা আমার প্রথম বাংলাদেশ সফর নয়। এর আগেও একবার এ দেশে এসেছি। আমার কিছু আত্মীয়-স্বজন খুলনায় থাকে। সে সূত্রেই এ দেশে এসেছিলাম। সেটাও প্রায় ২০ বছর আগের কথা। এত বছরে অনেক কিছুই বদলে গেছে। সে হিসেবে সফরটা প্রথম সফরের মতোই রোমাঞ্চকর লাগছে। 

প্রশ্ন: আজ ফোকফেস্টের দর্শকের কাছে কী প্রত্যাশা করছেন?

শাফকাত আমানত আলী : যতদূর জানি, এ দেশে সঙ্গীত অনুরাগী মানুষের সংখ্যা বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে বেশি। দর্শকের কাছে তাই প্রত্যাশা থাকবে, আমার সঙ্গে সবাই যেন গলা ফাটিয়ে গান গায়। গতকাল রাতে টিভিতে এ উৎসবে শিল্পীদের পরিবেশনা দেখেছি। অবাক হয়েছি এটা দেখে, অগণিত দর্শক কী উৎসাহ নিয়ে উৎসবে অংশ নিয়েছেন। আন্তর্জাতিক এ উৎসব সম্পর্কে আগেও অনেকের মতামত শুনেছি। প্রত্যেকের মুখে ছিল উচ্ছ্বসিত প্রশংসা। এবার নিজে এই উৎসবে গাইব- সেটা ভেবে শিহরিত হচ্ছি।

প্রশ্ন: লোকগানের পাশাপাশি সুফি এবং চলচ্চিত্রেও নানা ধরনের গান করেছেন। আজ কি নির্দিষ্ট কোনো ঘরানার গান গাইবেন, না বিভিন্ন ধরনের গান গাওয়ার ইচ্ছা আছে?

শাফকাত আমানত আলী : এটা ঠিক যে, আমি নানা ধরনের গান করি। কিন্তু সেটাই প্রাধান্য দেই, যা নিজের এবং দর্শক-শ্রোতার ভালো লাগে। মজার বিষয় হলো, ফোক বা সুফি গানের কনসার্টে গেলেও দেখি, বিভিন্ন ছবিতে গাওয়া আমার গানগুলো তারা শুনতে চান। আমিও দর্শক-শ্রোতার প্রিয় গানগুলো গেয়ে থাকি। জানি বিষয়টা নিয়ম ভঙ্গের মতো। কিন্তু দর্শকের পছন্দকে তো আর অস্বীকার করা যায় না। দর্শক চাইলে আজও নানা ধরনের গান গাইব। পাশাপাশি কিছু সুফি গানের নমুনাও তাদের সামনে তুলে ধরতে চাই। 

প্রশ্ন: আপনার অনেক গানে লোকসুরের ছাপ আছে। নিরীক্ষাধর্মী কাজের প্রয়াসেই এটা করা?

শাফকাত আমানত আলী : লোকগান খুব সহজেই সঙ্গীতপ্রেমীদের সঙ্গে আত্মিক যোগাযোগ ঘটাতে পারে। একবার স্পেনে শো করতে গিয়ে দেখেছি, আমার গাওয়া 'মতওয়া' গানের সঙ্গে স্পেনের ঐতিহ্যবাহী ফ্লেমিঙ্গো নাচ পরিবেশিত হচ্ছে। বিষয়টি আমাকে অনেক আলোড়িত করেছিল। এক দেশের চলচ্চিত্রের গানের সঙ্গে আরেক দেশের ঐতিহ্যবাহী নাচের এমন সম্মিলন ঘটতে পারে- আগে ভাবিনি। সেই পরিবেশনা দেখে অন্যরকম এক আনন্দে মনটা ছেয়ে গিয়েছিল। সঙ্গীত আসলে এমনই- নির্দিষ্ট কোনো ভাষা আর মানচিত্রের মাঝে তাকে বন্দি করে রাখা যায় না। সঙ্গীত নানা ঘরানার হলেও একটা যোগসূত্র থেকেই যায়। ফোক, সুফি, পপ, রক, ক্লাসিক, ফিউশন- যাই হোক না কেন, মনের তৃষ্ণা মেটানোই সঙ্গীত সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য। 

প্রশ্ন: ক্লাসিক্যাল ও সুফি গান দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন। অথচ আপনাকে এখন রক, পপ, ফিউশনসহ প্লেব্যাকে ভিন্ন আঙ্গিকের গান গাইতে দেখা যাচ্ছে। এর কারণ কী? 

শাফকাত আমানত আলী : ক্লাসিক্যাল ও সুফি গানের অনুরাগী হলেও প্রতিনিয়ত সঙ্গীত নিয়ে নিরীক্ষা করে থাকি। নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে যেমন আটকে থাকতে চাইনি, তেমনি শিল্পী হিসেবেও গায়কীর মধ্য দিয়ে বারবার নিজেকে ভাঙতে চেয়েছি। ব্যান্ড তৈরি করায় সঙ্গীত নিরীক্ষা বেড়ে গিয়েছিল। 'আখো কি সাগর', 'মধুওয়ান্তি রাগ'-এর সঙ্গে পপ গানের যোগসূত্র রাখার চেষ্টা ছিল। আর প্লেব্যকে তো ছবির কাহিনী, চরিত্র ও নানা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গান তৈরি করা হয়- যে জন্য সঙ্গীতের ধরনও বদলে ফেলতে হয়। সেই সুবাদে গায়কীতে নিজেকে নতুন করে তুলে ধরার সুযোগ থাকে। এটা ভেবেই নানা ধরনের গান করা। 

প্রশ্ন: কখনও সুযোগ পেলে এ দেশের লোকগান গাইবেন?

শাফকাত আমানত আলী : আমার স্ত্রীর কাছে এ দেশের গান সম্পর্কে যতটা জেনেছি, তাতে আপনা আপনি বাংলা গান গাওয়ার একটা ইচ্ছা তৈরি হয়েছে। সৈয়দ আবদুল হাদীর 'কেউ কোন দিন আমারে তো কথা দিল না'সহ অসংখ্য বাংলা গান শুনেছি। তার মধ্য দিয়ে এখানকার লোকগানের প্রতি আলাদা একটা আকর্ষণ জন্মে গেছে। সুফি গানের মতোই এ দেশের লোকগানে আলাদা ধরন আছে- যা অন্য কোনো ঘরানার গানের সঙ্গে মেলানো যাবে না। সুযোগ পেলে আবারও এ দেশে গান করতে চাই। বাবাও এ দেশে এসেছিলেন, গান গেয়ে দর্শকের ভালোবাসাও কুড়িয়েছেন। আমাকেও তার পথ অনুসরণ করতে দেখলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

পাঠকের মন্তব্য Login Registration