সেই আলপথে

প্রতিনিধি | সম্পাদকীয়

শনিবার ৮ ফেব্রুয়ারী ২০২০|১০:৫৫:৪০ মি.


সম্পাদক

মাটির বর্তনে ভাত। হা-ভাতে মানুষের খোরাক। সাথে লাল মরিচ, নুন ও বেগুনের সালুন। গোগ্রাসে গিলছে রোদে পিঠ ঠেকিয়ে। যেনো শীত তাড়াচ্ছে ভাত খেয়ে। প্রত্যন্ত গ্রামে এ দৃশ্য এখন আর খুঁজে পাবার নয়। শানকি কারো কাছে শখের উপকরণ। যা ছিল একসময় গাঁও-গেরামের মানুষের তিনবেলা আহারের সঙ্গী। মাটির শানকির দেখা মেলা ভার। কুমোরও আজকাল গড়ে  না এ বাসন। চাহিদা নেই যে, বাজারও নেই। মানুষ আর মাটির থালায় খায় না এখন। ভঙ্গুর জিনিসে বিশ্বাস নেই মানুষের। জীবনে যা কিছু প্রয়োজন সবই স্থায়ী হওয়া চাই। চাই আজীবন ব্যবহারযোগ্য উপাদান। যেনো সম্পদ উত্তরাধিকারের কাজে লাগে।

শানকি—বাংলার শেকড়ের প্রতীক। ঐতিহ্যগতভাবে কুমোরের গড়া হাঁড়ি-পাতিল, মটকা, কলস-ই চলেছে ঘর-গৃহস্থালী। বর্ষায় রঙিন পালের নায়ে ততোধিক পোড়া মাটির রঙে রঙিন কুমোর-গৃহস্থ বাড়ির ঘাটে হাজির হত। এতেই চলত বাংলার গাঁয়ের জীবন। বিনিময় ছিল ধান, চাল, পাট। খুশি ছিল ক্রেতা-বিক্রেতার অবয়ব। মাটির পাত্রের ব্যবহারে তখনি কী সামাজিক স্তরবিন্যাস ছিল? থাকলে, তা কতকাল আগে। জানি না। চাষির শুকনো ফসলের মজুদ কী মটকায় ছিল না? বীজ কী মাটির পাত্রেই রাখা হত না? আজ আর এমনটা নেই। নেই সেই গ্রাম। আছে শখের খামারবাড়ি। যেখানে আধুনিক কৃষি যন্ত্রের পাশে গড়ে উঠেছে সাইলো। আজ আর বাঁশের মাচায় মাটির পাত্র ভরে উঠে না ফলে-ফসলে।

সময়ের কলে কিছু জিনিস জমে থাকে স্মৃতি ভাঁড়ারে। কদিন যাবত মাথায় ঘুরছিল মাটির বর্তন। ইতি-উতি তাকিয়ে খুঁজলাম—কোথাও পেলাম না। যে মানুষটি হাত পেতে খায়—ঝোলায় তারও সিলভার থালা, নিদেনপক্ষে মেলামাইন। স্থায়ী কিছু চাই যা ওজনে কম, অভঙ্গুর। জীবন ভঙ্গুরতা চায় না এখন। চায় আধুনিকতা, চায় সময়ের সাথে তাল মেলানোর সুর। তাহলে ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি কী পুরনো তোরঙ্গের সাজ? মাঝে মাঝে তোরঙ্গ খুলে রোদে শুকাবার জিনিস।

শেকড় কী পেছনে টানে? নাকি গাছকে জীবনদানে জেগে থাকে অহর্নিশ। শেকড়ের যতেœ পেতে হবে ফুল ও ফসলের স্বাদ। তাইতো বিজ্ঞজনরা শেকড়ের খোঁজ নিতে বলেন। বলেন শিশু বিকাশের কল্প-কাহিনির দরোজা খুলে দিতে। বলেন রঙের সমাবেশে ডুবিয়ে দিতে শিশুমানস। পূর্বসূরী যেভাবে বিকশিত হয়েছিল একদিন। গড়েছিল জীবনের পথ। পৌঁছেছিল আপন ঠিকানায়। উত্তরসূরীকেও সে পথ দেখাতে হবে। ফিরিয়ে নিতে হবে বইয়ের পাতায়— ঠাকুরমা’র ঝুলিতে। ফেরাতে হবে হাজার কলস ভর্তি শক্তিমান সুপার হিরোর কাছে। যারা চাইলেই পারে সবকিছু। যা শিশুকে দেবে অসম্ভবকে সম্ভব করার শক্তি ও সাহস। তাইতো শেকড়ে ফিরতে হবে। যেতে হবে মাটির বর্তনের কাছে। যেখানে কোনো সামাজিক শ্রেণী বৈষম্য থাকবে না। থাকবে শুধু ঐতিহ্যের সুঘ্রাণ মাটির আলপথে।
 

পাঠকের মন্তব্য Login Registration