মুখোশ কখনো নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে কি কামালউদ্দিন নীলু

প্রতিনিধি | শিল্পকলা

মঙ্গলবার ১০ এপ্রিল ২০১৮|১৩:১১:০২ মি.



মুখ যা বলে তার চেয়ে অধিক বলে মুখোশ
অস্কার ওয়াইল্ড
মুখোশের সাহায্যে একজন মানুষ তার নিজের প্রকৃত রূপ সত্যিকারভাবেই প্রকাশ করতে পারে – যে রূপটি ঢাকা পড়ে থাকে তার চেহারার মাধ্যমে। এটা একটা নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা দর্শক উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হতে পারে। আরবি ভাষায় মুখোশের প্রতিরূপ ‘মাসখাহরা’, যার অর্থ ‘ধোঁকাবাজি’ বা ‘রূপান্তর’, আবার ইংরেজিতে এর অর্থ করা হয় – ‘প্রচ্ছন্ন রূপ’। একজন ব্যক্তির মানসিক জগৎটা প্রকাশ পায় তার মুখের মাধ্যমে, আর এই মুখ অর্থাৎ তাকে শনাক্ত করার মূল জায়গাটাকে যখন সে ব্যবহার করতে চায় না তখন মুখোশ তাকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় তার ‘পরিচয়’ থেকে এবং তার মানসিক জগৎটাকে প্রকাশ করে একটি ভিন্ন ব্যক্তি হিসেবে। এ প্রসঙ্গে জে ফোরম্যানের ব্যাখ্যা : ‘মুখোশ তার পরিধানকারীকে মুক্তি দেয় সকল ধরনের সংকোচ, নিয়মকানুন ও প্রাত্যহিক জীবনের বিভিন্ন খুঁটিনাটি বিষয় থেকে। তবে এটা একই সঙ্গে মনে করিয়ে দেয় বিশৃঙ্খলা, বিনাশ ও পরিবর্তনশীলতা, যা আমাদের সঙ্গেই আছে।’ 

১. মুখোশ এবং থিয়েটার
সক্রেটিসের সময় থেকে শুরু করে বর্তমানের আধুনিক পাশ্চাত্য থিয়েটার পর্যন্ত মুখোশ ব্যবহৃত হয়ে আসছে নাটকের রূপকতাকে প্রকাশ করার একটা প্রতীক হিসেবে। সহজভাবে বলা যায়, বহু যুগ ধরেই রূপায়ণের ক্ষেত্রে মুখোশ চরিত্রকে প্রতীকায়িত করে আসছে এবং নাটকের পারফরম্যান্স ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে এটি প্রধান ভূমিকা পালন করছে। এরপরেও বর্তমানে নাট্যবিষয়ক প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে একটা মূল বিষয় হিসেবে মুখোশের তথ্যনির্দেশ যথেষ্ট অপ্রতুল।বিশ শতকে শিক্ষার একটা সুনির্দিষ্ট উপকরণ হিসেবে মুখোশের ব্যবহার শুরু হয়েছে। প্রথমদিকে এটা অবশ্য অভিনয়শিল্পীদের প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহার করা হতো। অভিনয়শিল্পী ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে মুখোশ অভিনেতা-অভিনেত্রীদের আত্মপরিচয় থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় এবং উভয় ক্ষেত্রেই শিল্পীদের একটা ‘অন্য’ সত্তায় পরিণত করে, যা অনেকটা ওঝাদের মতো ব্যাপার। আর এই বিচ্ছিন্নতার মাধ্যমে শিল্পী তার নিজের সত্তাকে আরো নিবিড়ভাবে অনুভব করতে পারে। 

জে কিফে ও এস মারির মতে :

মুখম-লে একটা বিশেষ মাত্রা যোগ করার অন্যতম উপায় হলো মুখোশ। যখনই শিল্পীরা মুখোশ পরেন, তখনই তাঁদের শরীরের সম্মোহনটা চলে যায়। তাঁরা মুখম-লের সমস্ত অভিব্যক্তি ও পেশির  নড়াচড়া বন্ধ করে দেন, মুখম-লের অসামান্য ঐশ্বর্য চলে যায়। শিল্পীর সঙ্গে তাঁর মুখম-লের (জাপানি ভাষায় কামেন) এমন একটা বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয় যে তখন তাঁর মুখটা হয়ে যায় মৃত। এই ব্যাপারটা অবশ্য শিরশ্ছেদের সঙ্গেও তুলনা করা যায়। আর এ কারণেই একজন শিল্পীর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো : একটা স্থির, নিশ্চল ও অটল বস্ত্তকে একটা জীবন্ত ও ব্যঞ্জনাপূর্ণ অবস্থায় পরিণত করা।
মুখোশ নিয়ে অধ্যয়ন করার ক্ষেত্রে মুখোশকে ঘিরে পরস্পর সংযুক্ত বিভিন্ন ধরনের জ্ঞানের সঙ্গে বোঝাপড়া করাই  সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। আর এক্ষেত্রে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে পারফরম্যান্স ও থিয়েটার অ্যানথ্রপোলজি পর্যন্ত মুখোশকে ঘিরে আছে শারীরিক থিয়েটার। তাত্ত্বিক/শিল্পী যেমন, ব্রেখট, লেকক, গ্রোটোস্কি ও ব্রম্নক এবং একই সঙ্গে ফ্যাভিও, ফো, বারবা ও মায়ারহোল্ডকেও এক্ষেত্রে উপেক্ষা করা যায় না। মুখোশ কী করতে পারে এবং কীভাবে মুখোশকে ব্যবহার করা হয় – এই দুটোর মধ্যে মূলগত পার্থক্য রয়েছে।মুখোশ কী করতে পারে এ ব্যাপারে গবেষণার কাজটিকে বিভক্ত করা যায় দর্শকের ওপরে মুখোশের প্রভাব এবং মুখোশ যিনি ব্যবহার করছেন তাঁর ওপরে মুখোশের প্রভাব – এই দুটো ভাগে। এই দুটো ভাগ আসলে মুখোশের কার্যকারিতার ওপরে নির্ভর করছে। কাজের দিক থেকে মুখোশ হতে পারে সাধারণত প্রতিনিধিত্বমূলক, আবেগপূর্ণ, সুনির্দিষ্ট কোনো অভিব্যক্তিমূলক বা ছদ্মবেশী। মুখোশের এই ধরনের কাজগুলো দর্শকদের ওপরেও
ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে মুখোশ তার দর্শকদের কাছে একটা রূপক বা প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয় এবং এটি শিল্পীকে দর্শকদের কাছ থেকে পৃথক করে রাখে এবং একটা দূরত্ব সৃষ্টি করে, যেটাকে উপলব্ধির ক্ষেত্রে বলা যায় এলিয়েনেশন ইফেক্ট। আরেকটু সহজভাবে বলা যায়, দর্শককে জোর করে অর্থ বোঝানোর চেয়ে মুখোশ দর্শকদের তাদের মতো করে একটা অর্থ তৈরি করতে দেয় এবং এই অর্থের আলোকেই তাদেরকে পারফরম্যান্সের বার্তাটা উপলব্ধি করতে সুযোগ করে দেয়। এলিজাবেথ টোনকিন মনে করেন, মুখোশ হচ্ছে শক্তিকে গ্রন্থিবদ্ধ করার একটি মাধ্যম, আর এই শক্তিটা হচ্ছে একজন ব্যক্তির নিজেকে রূপান্তর করে অন্য একজন হয়ে যাওয়া। দর্শকদের ক্ষেত্রে এই শক্তিটা হলো নিজের বোধের নিয়ন্ত্রণ ও জ্ঞান অর্জন। এই বিশেস্নষণটা মানসিক অবস্থা ও বোধের প্রতি দৃষ্টি প্রদান করলেও পোলক মনে করেন, এই বিশেস্নষণটা একটা ব্যাপারে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে, আর তা হলো : দর্শকেরা কখনোই ভাবেন না যে মুখোশ কীভাবে কাজ করে, বরং তারা ভাবেন যে মুখোশ কী কী করতে পারে।
পোলক এরপরে মুখোশ কী করতে পারে এ সম্পর্কে বলেছেন :
মুখোশ সেই সমস্ত পরিচয়ের চিহ্নকে লুকিয়ে রাখে বা পরিবর্তন করে, যেগুলো তুলে ধরে একটা রূপান্তরিত ব্যক্তিকে বা তার পুরো নতুন পরিচয়টাকে। যদিও প্রতিটি সংস্কৃতিতে অনেক ধরনের মাধ্যম রয়েছে, যেগুলোর সাহায্যে পরিচয়কে উপস্থাপন করা যায় আর পরিচয় প্রকাশের সেইসব প্রথাগত চিহ্নকে গ্রহণ করার মাধ্যমে একটা মুখোশ নিজেই সমৃদ্ধ হয়। পোলকের ভাবনা নিয়ে প্রচুর গবেষণা হয়েছে আর এতে একটা ব্যাপার বোঝা যায় যে, বিংশ শতাব্দীর থিয়েটার চর্চায় হয়তো বা অত্যন্ত অসতর্কতার সঙ্গে মুখোশ ব্যবহার করা হয়েছে। অবশ্য বিংশ শতাব্দীতে মহড়ার একটি অংশ হিসেবে মুখোশের ব্যবহার মোটেই নতুন কোনো ভাবনা নয়, বরং বলা যায় একবিংশ শতাব্দীর থিয়েটার চর্চার ক্ষেত্রেই এটির অভাব বেশ ভালোভাবেই পরিলক্ষক্ষত হয়। প্রথাগত পরিচয়কে পরিবর্তনের জন্য মুখোশের ব্যবহার লক্ষ করা যায় বের্টল্ট ব্রেখটের নাটকগুলোতে। তিনি তাঁর নাটকগুলোতে মুখোশ ব্যবহার করেছেন দর্শককে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার একটা অংশ হিসেবে। মায়ারহোল্ড ও এডউইন পিসকাটরের ভাবনা-আশ্রিত এই মুখোশ আসলে দর্শকদের একজন সচেতন দর্শক হিসেবে প্রদর্শনীটা দেখতে দেয়। এটা গ্রিক থিয়েটারে মুখোশের ব্যবহারের তুলনায় অবশ্য ভিন্ন, কারণ গ্রিক থিয়েটারে মুখোশ ব্যবহার করা হতো সংস্কৃতি ও পারফরম্যান্সের কৌশলগত কারণে। পি মেইনেকের যুক্তি :
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটা হলো, একটা খোলা জায়গায় নাট্যক্রিয়া সৃষ্টির জন্য মুখোশ খুব ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখতে পারে। একজন শিল্পী মুখোশ পরার সঙ্গে সঙ্গে দর্শকদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান, এটা অনেকটা আকর্ষণ সৃষ্টির মতো যে খুব দ্রম্নতই একটা নাট্যাভিনয় শুরু হতে যাচ্ছে। আরেকটা ব্যাপার হলো, একটা খোলা জায়গায় নাটক পরিবেশনের ক্ষেত্রে এটা একটা নান্দনিক মাত্রা যোগ করে এবং এটা মানসিক যোগাযোগ ও দৃষ্টি আকর্ষণেরও একটা উপায় হিসেবে কাজ করে। আর মুখোশ প্রকৃতপক্ষে তার দিকে মানুষকে তাকাতেও বাধ্য করে।

 

২. গ্রিক থিয়েটার
গ্রিক থিয়েটারের উৎপত্তি ঘটেছিল ডায়োনিসাসের উৎসবকে কেন্দ্র করে। এই উৎসবে পারফরম্যান্সের সময় মুখোশ ব্যবহার করা হতো চরিত্রকে অতিরঞ্জিত এবং জোরালো করার উদ্দেশ্যে, আর সেইসঙ্গে দর্শকদের সামনে চরিত্রটিকে আরো দর্শনীয় করে তোলারও একটা দায় ছিল। গ্রিক নাটকগুলো পরিবেশন করা হতো খোলা আকাশের নিচে এবং বিশাল আকারের মিলনায়তনে, সেখানে দর্শকেরা যত দূরেই বসে থাকুক না কেন খুব পরিষ্কারভাবে অভিনেতাদের সংলাপ শুনতে পেত। আর এটা করার জন্য অভিনেতাদের হাঁটাচলায় থাকত দৃঢ়তা এবং যা অত্যন্ত স্টাইলাইজড। অভিনেতারা পুরো মুখজুড়েই মুখোশ ব্যবহার করত, সেই তুলনায় সেট বা প্রপস ব্যবহার করত খুব কম। মুখোশ ব্যবহার করার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল নাটক পরিবেশনের জায়গাটার বিশালতা এবং দর্শক ও অভিনেতাদের মধ্যে দূরত্ব। এছাড়া মুখোশ ব্যবহারের ফলে তিনজন অভিনেতা চাইলে অনেকগুলো চরিত্রে অভিনয় করতে পারত। অবশ্য প্রথমদিকে নাটকে থাকত একজন অভিনেতা ও কোরাস দল, তবে পরবর্তী সময়ে আসেত্ম আসেত্ম অভিনেতার সংখ্যা তিনজন হয়ে গেল এবং সেইসঙ্গে কোরাস তো ছিলই।
গ্রিক থিয়েটারে অভিনেতাদের পুরো মুখজুড়েই মুখোশ ব্যবহৃত হতো, তবে মুখোশগুলো নিরপেক্ষ অভিব্যক্তির ছিল না। সেগুলোতে থাকত অতিরঞ্জিত অভিব্যক্তি, যেটা অভিনেতা ও কোরাসদের মঞ্চে অত্যন্ত স্পষ্ট ও সুনির্দিষ্টভাবে হাঁটাচলা করতে সাহায্য করত। মুখোশ পরে কোরাসদল হাঁটাচলা করতে করতেই সংলাপ বলত বলেই একটা বিশাল আকারের দৃশ্য তৈরি হতো, যেটাকে কল্পনা করা চলে দৃশ্যকাব্যের সঙ্গে।

ডেভিড উইলস, যিনি গ্রিক থিয়েটার ও মুখোশ সম্পর্কে বিসত্মারিত লিখেছেন, তাঁর মতে মুখোশের ব্যবহারটা ছিল আসলে পারফরম্যান্সের কৌশলগত কারণেই, ফলে এর সঙ্গে গ্রিক ট্র্যাজেডির ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও শ্রদ্ধা – এইসব মিলেমিশে মুখোশ নাটকের সঙ্গে সঙ্গেই গড়ে উঠেছে নৃতত্ত্বের মর্যাদাসম্পন্ন একটি উপাদান। উইলস বলেন : ‘ইতিহাসের কোনো বীর চরিত্র সম্পর্কে কিছু বলতে গেলে ধর্মীয় ব্যাপার-স্যাপার এসেই পড়ে। আর মুখোশই এই ট্র্যাজিক চরিত্রকে মহিমান্বিত করে তোলে।
মুখোশের আরো একটা অর্থ হলো এটা অভিনেতা ও দর্শকদের সুকৌশলে পারফরম্যান্সের রাজনৈতিক সংশিস্নষ্টতা থেকেও রক্ষা করে, যেমনটি কমেডিয়া দেল আর্তের ক্ষেত্রে। এখানেও অভিনেতা ও দর্শকদেরকে মুখোশ নিরাপত্তা দেয় এবং দূরে সরিয়ে রাখে পারফরম্যান্সের রাজনৈতিক সংশিস্নষ্টতা থেকে। এস এইচ স্মিথের মতে : মুখোশ একটা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির মাধ্যমে দর্শকদেরকে অভিনেতাদের পরিচয় থেকে দূরে রাখে বা এটা দর্শক ও চরিত্রের মধ্যে একটা নান্দনিক দূরত্ব সৃষ্টি করে, অর্থাৎ এটা অভিনেতাকে দর্শকদের কাছ থেকে আড়াল করে রাখে। এর পেছনের মূল ব্যাপারটা হলো, এটা দর্শকদেরকে সহানুভূতিশীল ও আবেগী হতে দেয় না, বরং এটা তাদের ঠেলে দেয় বিশেস্নষণাত্মক ও বিচক্ষণ হওয়ার দিকেই। ক্রিস ভারভেইন এ সম্পর্কে বলেছেন যে, অ্যারিস্টটলের ভাবনা অনুসারে চরিত্র হচ্ছে ক্রিয়া সহায়ক, আর এ কারণেই মুখোশের ছয় ধরনের ব্যবহার রয়েছে, যেগুলো দর্শকেরা খুব সহজেই শনাক্ত করতে পারেন। একইভাবে, ডেভিড গ্রিফিথস বলেছেন যে, নো ও কমেডিয়া দেল আর্তের অভিনেতারা চরিত্রের ধরন অনুসারে মুখোশ ব্যবহার করত, যেটাকে দর্শকেরা খুব সহজেই চিনতে পারত : নো নাটকের শিল্পীরা দর্শকদের সামনে নিজেদের তুলে ধরতেন মুখোশ ও কস্টিউমের সাহায্যে। এর ফলে তাঁদের চরিত্রগুলোকে খুব সহজেই চেনা যেত। তাঁরা কে বা কাকে উপস্থাপন করছেন সেটা আগে থেকে না শুনেও তাঁদের উপস্থাপনা দেখেই সেটা চেনা যেত।

৩. কমেডিয়া দেল আর্তে

১৫০০ খ্রিষ্টাব্দে ইতালিতে কমেডিয়া দেল আর্তের উৎপত্তি হয়েছিল। এশিয়ার অনেক ঐতিহ্যবাহী নাট্য পরিবেশনার অভিনেতাদের মতোই কমেডিয়া ডেল আর্তের অভিনেতারাও শুধু একটি চরিত্রেই অভিনয় করত এবং তাদের দক্ষতাকে অত্যন্ত উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যেত। পরিবেশনার গল্পটি সুনির্দিষ্ট কিছু চরিত্রকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হতো, ফলে যে সমস্ত গ্রামবাসী এই ভ্রমণকারী দলটিকে আমন্ত্রণ জানাত তারা পরিবেশনাটির প্রকৃতি ও আচার-আচরণ সহজেই বুঝতে পারত এবং দলটিকে বিভিন্ন ঘটনা ও মানুষ সম্পর্কে বিদ্রূপাত্মক বিভিন্ন উপাদান যোগ করতে সাহায্য করত, ফলে গ্রামবাসীর কাছে তখন এটা অত্যন্ত উপভোগ্য হয়ে উঠত। বেইনস ও ও’ব্রায়ান এই নাট্যক্রিয়া সম্পর্কে তাদের নেভিগেটিং ড্রামা বইটিতে খুব সরল ভাষায় বলেছেন : কমেডিয়াতে কোনো জটিল চরিত্রায়ণ নেই, কোনো ট্র্যাজেডি নেই, চরিত্র বিকাশের কোনো প্রক্রিয়া নেই, এমনকি কোনো মনসত্মাত্ত্বিক বাস্তবতাও নেই। শুধু মৌলিক কমেডি আছে।

কমেডিয়া দেল আর্তের পারফরম্যান্সে গভীরতা নেই এই অভিযোগের ব্যাপারে কমেডিয়া দেল আর্তের শিল্পীরা, যেমন আমেত্মানিও ফাভা, জন রুডলিন ও দারিও ফো দ্বিমত পোষণ করেছেন। এ ফাভার মতে : কমেডিয়া দেল আর্তে হলো পরিপূর্ণ, সম্পূর্ণ, টোটাল থিয়েটার, যেটাতে রয়েছে থিয়েটারের বিভিন্ন ফর্মের কলাকৌশল ও শৃঙ্খলা। তবে এ সত্ত্বেও কমেডিয়া দেল আর্তে পুরোপুরি স্বতন্ত্র ও স্বাধীন। কমেডিয়াতে মনস্তত্ত্ব রয়েছে পুরো অংশজুড়েই…এটাতে দেখা যায় ঐতিহ্যের সর্বজনীনতা, সেইসঙ্গে রয়েছে পারফরম্যান্সের কিছু তাৎক্ষণিক মুহূর্ত, যেটার মাধ্যমে অভিনেতারা তাদের সামনেই উপস্থিত থাকা প্রকৃত, জীবন্ত দর্শকের সঙ্গে সংস্কৃতি, অভিব্যক্তির ছন্দ, পারস্পরিক বোঝাপড়া ও সম্পৃক্ততা আদান-প্রদান করে। ইতালির এই মুখোশনির্ভর কমেডিয়া দেল আর্তের অভিনেতারা অর্ধ-মুখোশ ব্যবহার করত স্টক চরিত্রগুলো উপস্থাপনের জন্য – এই চরিত্রগুলো অবশ্য দর্শকদের কাছে বেশ ভালোভাবেই পরিচিত ছিল। মুখোশ ব্যবহারের মাধ্যমে অভিনেতারা তাদের নিজেদের আড়াল করে রাখত। মুখোশগুলোর অবয়বে থাকত চরিত্রগুলোর বিভিন্ন হাস্যরসাত্মক উপাদান। মুখোশগুলো আসলে চরিত্রগুলোকেই উপস্থাপন করত, উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মুখোশের রং এবং নাকের আকৃতির মাধ্যমে। এই রং ও আকৃতিগুলো নির্বাচন করা হতো গ্রিক দার্শনিক ও ডাক্তার গ্যালেন প্রবর্তিত মানসিক প্রকৃতির বিভিন্ন বিভাগ অনুসারে। লাল রং ব্যবহার করা হতো শক্তিমানের প্রতীক হিসেবে – যিনি যুক্তিবাদী, এমনকি আত্মবিশ্বাসী। হলুদ রং ব্যবহার করা হতো রাগ, নিচু মানসিকতা ও সন্দেহবাতিকগ্রসেত্মর প্রতীক হিসেবে। নীল রং ব্যবহার করা হতো অন্তর্মুখিনতা, অসন্তুষ্টি এবং একজন বিশুদ্ধ মানুষের প্রতীক হিসেবে, অবশ্য মাঝে মাঝে ‘বিচলিত’ মানুষের প্রতীক হিসেবেও এই রং ব্যবহার করা হতো। সবুজ রং ব্যবহার করা হতো আবেগশূন্যতা, অলস, পরিবর্তনে আগ্রহী নয় এবং পরমুখাপেক্ষেতার প্রতীক
হিসেবে।

৪. মায়ারহোল্ড

ভসেভলোদ মায়ারহোল্ডই আধুনিক থিয়েটারে মুখোশকে পুনর্বাসন করেছেন, আর তিনি এটা করেছেন নাট্যাভিনয় এবং তার অভিনেতাদের নাট্য প্রশিক্ষণ উভয় ক্ষেত্রেই। বলশেভিক রাশিয়াতে ভসেভলোদ মায়ারহোল্ডই ছিলেন একমাত্র থিয়েটার চর্চাকারী, ছিলেন কনসত্মানতিন সত্মানিসস্নাভস্কির ছাত্র এবং একই সঙ্গে তাঁর সহযোগী ও প্রতিদ্বন্দ্বী। মায়ারহোল্ডের ভাবনা সম্পর্কে সত্মানিসস্নাভস্কি দ্বিমত পোষণ করেছিলেন এবং ভাবনাটিকে সমৃদ্ধ করার ব্যাপারে সহযোগিতা করতে চেয়েছিলেন। মায়ারহোল্ড ত্রিশের দশকে সত্মালিন ঘোষিত তাঁর মৃত্যুদ–র পরে সত্তরের দশক থেকে আসেত্ম আসেত্ম রাশিয়ার সংস্কৃতিতে পুনর্জীবন লাভ করতে থাকেন। আর এই সময়টার পরেই মায়ারহোল্ড অন্তর্ভুক্ত হতে থাকেন আন্তর্জাতিক পাঠ্যক্রমে এবং বেশ কয়েকজন থিয়েটার ব্যক্তিত্ব, যেমন, জ্যাক কোপ্যু, এতিয়েন দ্যোকুসহ আরো অনেকের কাছেই বিবেচিত হতে থাকেন অত্যন্ত প্রভাব বিসত্মারকারী ব্যক্তিত্ব হিসেবে। তিনি প্রথমে তাঁর নাট্যচর্চা শুরু করেছিলেন সত্মানিসস্নাভস্কির নাট্যদলে একজন অভিনেতা হিসেবে, তারপর তিনি মুখোশ ও কমেডিয়া দেল আর্তে নিয়ে কাজ করতে শুরু করেন এবং এরপরে তাঁর প্রতিভা বিকাশ লাভ করে স্টেজ ডিজাইন, দর্শকের সঙ্গে সম্পর্ক, মিউজিক, রাজনৈতিক ও উপদেশমূলক থিয়েটার, মন্তাজ, নাটক লেখা এবং সবশেষে শারীরিক থিয়েটারের রীতির মাধ্যমে, যেটাকে বলা হচ্ছে বায়োমেকানিকস। ব্যাপারটা হলো, শরীর ও আকাঙক্ষাকে পৃথক করে ফেলতে হবে এবং বায়োমেকানিকসের মাধ্যমে একটা নতুন কিছু সৃষ্টি করতে হবে; যদিও শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করার পেছনে ভসেভলোদ মায়ারহোল্ডের আরো একটা প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল, সেটা হলো একটা প্রতীকনির্ভর পারফরম্যান্স সৃষ্টি করা। মায়ারহোল্ড অত্যন্ত অতৃপ্ত ছিলেন সত্মানিসস্নাভস্কির মনসত্মাত্ত্বিক শর্তনির্ভর পারফরমান্সের ব্যাপারে, আর এটাই তাঁকে চালিত করেছিল কমেডিয়া দেল আর্তের পারফরম্যান্সটাকে পুনরাবিষ্কার করতে। তিনি ব্যবহার করেছিলেন কিছু অদ্ভুত চরিত্র, অদ্ভুত দৃশ্য এবং তৈরি করেছিলেন বেশকিছু নিরীক্ষামূলক ও চ্যালেঞ্জিং পারফরম্যান্স। মায়ারহোল্ডস থিয়েটার অব গ্রোটেস্ক বইটাতে আলোচনা করা হয়েছে মায়ারহোল্ডের বায়োমেকানিকসবিহীন কাজগুলো নিয়ে এবং এঁতুদে সম্পর্কে, যেখান থেকে অনেক টেক্সটের উদ্ধৃতিও আছে। তবে বইটাতে তাঁর অন্যান্য নাটক নিয়েই বেশি আলোচনা করা হয়েছে, যেগুলো তাঁকে তৈরি করতে সাহায্য করেছে তাঁর নিজের তত্ত্বকে, যেটাকে আমরা বলছি কমেডিয়া দেল আর্তের মাধ্যমে মায়ারহোল্ডের অদ্ভুতের অন্বেষণ। বায়োমেকানিকসে মায়ারহোল্ড যে তত্ত্বটা ব্যবহার করেছেন সেটা অত্যন্ত নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে মুখোশের ব্যবহারের মধ্যে। আর মায়ারহোল্ড এটার আলোকেই পারফরম্যান্স, থিয়েটার ও নাটকের ক্ষেত্রে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

এটা বোঝা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে থিয়েটারের পেছনে মায়ারহোল্ডের আগ্রহের অন্যতম কারণ হলো তাঁর সমাজ
পরিবর্তনের একটা রাজনৈতিক আকাঙক্ষা এবং সমাজের ওপরে থিয়েটারের প্রভাব সম্পর্কে একটা দৃঢ় বিশ্বাস, যে বিশ্বাস বিংশ শতাব্দীর পশ্চিমা দেশগুলো থেকে হারিয়ে গিয়েছিল। মায়ারহোল্ড বুঝতে পেরেছিলেন যে, সমাজ নিয়ে কমেডিয়া দেল আর্তের রাজনৈতিক ভূমিকা কতটুকু ছিল, আর সেটা পুরোপুরি মিলে গিয়েছিল পরিবর্তন সম্পর্কিত তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাসের সঙ্গে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন রাশিয়ার দরিদ্র কৃষকদের কিংবা একইভাবে পঞ্চদশ শতাব্দীর ইতালির কৃষক শ্রেণির ভেতরে জাগরণ সৃষ্টি করতে চাইলে সমাজের প্রভাবশালীদের প্রতি একটা বিদ্রূপাত্মক ভূমিকা পালন করতে হবে তাঁকে, আর এই কারণেই তিনি কমেডিয়া দেল আর্তের অদ্ভুত সব উপাদানের প্রতি ঝুঁকে গিয়েছিলেন, তবে এটাকে তিনি রূপান্তর করেছিলেন একটু একটু করে প্রস্ফুটিত হতে থাকা বিংশ শতাব্দীর থিয়েটার আন্দোলনের জন্য। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হচ্ছে বিদ্রূপ ব্যাপারটা কিন্তু বহু আগে থেকেই প্রভুত্বপরায়ণ রাজনীতিকে সংশোধনের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

মায়ারহোল্ডের এই অদ্ভুত ব্যাপারগুলো ছড়িয়ে আছে তাঁর প্রযোজনা দ্য ম্যাগনিফিশেন্ট কাকোল্ড থেকে দ্য ডেথ অব টারেলকিন (রাশিয়ান ক্ল্যাসিক, যেটা মায়ারহোল্ড তাঁর ধারায় মানুষের সামনে পুনরায় তুলে ধরেছিলেন) এবং দ্য কোর্ট রেবেলিয়ন পর্যন্ত। পারফরম্যান্সে মুখোশের ব্যবহার নিয়ে মায়ারহোল্ডের সচেতনতা এবং মানুষের সত্তার ভেতরে থাকা ‘অদ্ভুত’ ব্যাপারটিকে বাইরে বের করে আনার ক্ষেত্রে মুখোশের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত বিসত্মৃত। মায়ারহোল্ডের অর্জন কতটা উচ্চতায় পৌঁছেছিল এ সম্পর্কে বলতে গেলে বলা যায়, মায়ারহোল্ড এতটাই শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিলেন যে অতটা শীর্ষে তিনি আর কখনোই যেতে পারতেন না। যদিও পরবর্তী সময়ে মায়ারহোল্ড তাঁর এতুঁদে ও বায়োমেকানিকস নিয়ে শারীরিক পারফরম্যান্সের স্বরূপ উদ্ঘাটনে আত্মনিয়োগ করেছিলেন, যেটা ছিল পারফরম্যান্সের উন্নয়নে মুখোশের শক্তি সম্পর্কিত একটা পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণ, যার প্রকাশ তাঁর প্রযোজনা দ্য ফেয়ারগ্রাউন্ড বুথে।

৫. ব্রেখট

ব্রেখট মুখোশকে অবলম্বন করেছিলেন বিচ্ছিন্নতার একটা মাধ্যম হিসেবে, যাতে দর্শকেরা মঞ্চের ক্রিয়া থেকে নিজেদেরকে সরিয়ে রাখতে পারেন। ব্রেখট এটার নাম দিয়েছিলেন ‘বিচ্ছিন্নতার প্রভাব’। আর এটা তৈরি হয়েছিল মায়ারহোল্ড-সৃষ্ট ‘নান্দনিকতার স্বতঃনিয়ন্ত্রিত উপলব্ধি’র মাধ্যমে। ব্রেখটের মুখোশনির্ভর নাটকের মধ্যে রয়েছে ককেশিয়ান চক সার্কেল, যেখানে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল অভিব্যক্তিনির্ভর মুখোশ। এই ধরনের মুখোশের ব্যবহার শুধু মুখম-লের অভিব্যক্তিতে আটকে না থেকে অভিনেতার শারীরিক কসরতের সঙ্গেও অভিযোজিত হতো, ফলে নাটকের বক্তব্যটি খুব সহজেই দর্শকদের বোঝানো যেত। ব্রেখট শুধু মুখোশের তাত্ত্বিক বিষয়েই আটকে থাকেননি, বরং অভিনেতারা কীভাবে তাদের পারফরম্যান্সের সময়ে এটা ব্যবহার করছে এবং মুখোশ কেমন করে দর্শকদের প্রতিক্রিয়াকে টেনে বের করে আনছে সেগুলোর ওপরেও গুরুত্ব দিয়েছেন। 

৬. কোপ্যু

নাট্যবিষয়ক শিক্ষকেরা, যাঁরা ইউরোপে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন এবং মহড়ার ক্ষেত্রে শারীরিক কসরতকে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছেন তাঁরা নিশ্চয়ই তাঁদের শেকড় ভিয়োঁ কলম্বিয়েকে প্রশিক্ষণের কেন্দ্রস্থল হিসেবে মনে করেন এবং এই জায়গাটি ও জ্যাক কোপ্যুর কাজগুলোকে নিশ্চয়ই তাঁরা ভুলে যাননি। কোপ্যু মায়ারহোল্ডের আকাঙক্ষাকেই বাস্তবায়ন করেছেন, যেটি ছিল পশ্চিমা বিশ্বে অভিনেতাদের নাট্য প্রশিক্ষণের উন্নয়নের মাধ্যমে পারফরম্যান্সের উন্নয়নের একটি নতুন পদ্ধতি খুঁজে বের করার প্রক্রিয়া। উত্তর আমেরিকায় অভিনেতাদের প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে পারফরম্যান্সে মনসত্মাত্ত্বিক সত্যটাকে অনুসরণ করতে বলা হয়, যেটার উৎপত্তি সত্মানিসস্নাভস্কির তত্ত্বের ভেতরে, আর এটাকে গ্রহণ করা হচ্ছে নাট্য প্রশিক্ষকদের বিভিন্ন মতবাদের মাধ্যমে, উদাহরণ হিসেবে ইউটা হেজেন ও রুডলফ স্টাইনারের কথা বলা যায়। তাঁদের প্রক্রিয়াটা অনেকটা ইউরোপকেন্দ্রিক একটা পদ্ধতি, যেটাতে জোর দেওয়া হয়েছে শরীর এবং তার নিয়ন্ত্রণকে, আর এ ধরনের তত্ত্ব বিকশিত হয়েছে গ্রোটোস্কি ও মাইকেল সেইন্ট-ডেনিসের মাধ্যমে।

শারীরিক থিয়েটার ও মুখোশ নিয়ে কাজ করেছেন এমন কয়েকজনের কথা বলা যায়, যেমন – এতিয়েন দ্যোকু, জ্যঁ লুই ব্যারল্ট, জ্যাক লেকক এবং মাইকেল সেইন্ট-ডেনিস, তাঁরা সবাই কোপ্যুর অধীনেই শিক্ষা লাভকরেছেন। এছাড়া আরো কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা যায়, যাঁরা বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে কোপ্যুর সঙ্গে কাজ করেছেন, যেমন – জ্যঁ ও মেরি-হেলেন দাসেত্ম, জ্যঁ ডরসি, চার্লস ডালিন, লুই জুভে ও মার্সেল মাসোঁ। কোপ্যু মনে করতেন ইম্প্রোভাইজেশন ও অভিনেতাদের প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপাদান হলো মুখোশ। তিনি মনে করতেন, মুখোশ একজন অভিনেতাকে তার নিজস্ব বাস্তবতাকে ঢেকে রাখতে সাহায্য করে এবং তার নিজস্ব দ্বিধা ও সংকোচকে দূরে সরিয়ে তাকে রূপান্তরিত হতে সহায়তা করে, ফলে মুখোশটা তখন পারফরম্যান্সের মনস্তত্ত্বকে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে অভিনেতা/পারফরমারের জন্য একটি মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে যে মুখোশ দুই ধরনের কাজ করে, অভিনেতার জন্য একটা মনসত্মাত্ত্বিক ও শারীরিক মাধ্যম হিসেবে এবং সেইসঙ্গে দর্শকদের জন্য একটা রূপক হিসেবে। তিনি মনে করতেন যে, মুখোশ একজন অভিনেতাকে তাঁর মুখম-লের অভিব্যক্তির প্রতি মনোযোগ না দিয়ে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে তাঁকে শরীরের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে সহায়তা করে। মায়ারহোল্ডের মতোই, ইউরিদমিকসের ছন্দ ও ধারণার তত্ত্ব যেটা উদ্ভাবন করেছিলেন আপ্পিয়া ও দালক্রোজ সেটা হয়ে পড়েছিল তার মূল দর্শন। থিয়েটারকে পুনর্গঠনের জন্য কোপ্যুর অভিযানটা শুরু হয়েছিল ‘তারকা প্রথার ক্ষতিকর প্রভাব এবং বাণিজ্যিক
স্বার্থসাধন’কে থামিয়ে দেওয়ার আকাঙক্ষা থেকে। তাঁর আরেকটি আকাঙক্ষা ছিল অভিনেতাদের তিনি পারফরম্যান্সের ভিত্তিমূলে ফিরিয়ে আনবেন এবং সহজলব্ধ চাতুরীটাকে দূর করে দেবেন। শারীরিক কসরত ও ছন্দের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে গিয়ে কোপ্যু কেন প্রশিক্ষণের মাধ্যম হিসেবে মুখোশ বেছে নিয়েছিলেন সেটা সম্পর্কে অ্যালিসন হজ খুব অল্প কথায় বলেছেন :

তিনি (কোপ্যু) কখনো কখনো মহড়া শেষে বসে থাকতেন এবং মঞ্চের ওপরে কাঠমিস্ত্রিদের কাজ দেখতেন। তাদের কাজটাকে তাঁর কাছে মনে হতো সংকল্পবদ্ধ, ছন্দময় ও অত্যন্ত আন্তরিক। অথচ মহড়ার সময়ে অভিনেতাদের কাজটাকে তাঁর কাছে মনে হতো অস্বাভাবিক এবং তারা যেন জোর করে মহড়াটা করছে – তাদের ভেতরে শিল্পকুশলতার অভাব রয়েছে।

কোপ্যু তাঁর ভাবনাগুলোকে কাজে পরিণত করার জন্য তাঁর নাটকের স্কুলটাকে ব্যবহার করেছিলেন। প্রথমে তিনি ছয়জনকে নিয়ে শুরু করেছিলেন এবং তাঁর লক্ষ্য ছিল তরুণদের পাশাপাশি বয়স্কদেরকেও তিনি প্রশিক্ষণ দেবেন। আসলে সেই সময়টাতে বেশ অনেকভাবেই ভিয়োঁ কলম্বিয়ে হয়ে পড়েছিল নাট্যশিক্ষার একটা অনুসরণযোগ্য কেন্দ্রে, যেখানে প্রযোজনা তৈরির প্রক্রিয়াটা বেশ ভালোভাবেই সম্পাদন হচ্ছিল। এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটা এখন সরে এসেছে শ্যাতু দ্য মোথাইলে এবং নামধারণ করেছে লে কোপিয়াস। সেই সময়কার প্রযোজনাগুলোতে কমেডিয়া দেল আর্তের মুখোশ ব্যবহার করা হতো, আর প্রশিক্ষণের সময় কোপ্যুর অভিনেতাদের বেশ কয়েকটা ব্যাপারে দৃষ্টিনিবদ্ধ করতে হতো : শ্বাসপ্রশ্বাস, তাল ও শারীরিক কসরত। এ প্রসঙ্গে অ্যালিসন হজের ব্যাখ্যা : 

মুখোশের ক্ষমতা সম্পর্কে কোপ্যু বেশ সচেতন ছিলেন, আর এই সচেতনতা অভিনেতাদের প্রশিক্ষণ এবং পারফরম্যান্সের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে, কারণ সে সময়টাতে তিনি ক্রেইগের (এডওয়ার্ড গর্ডন) সঙ্গে কাজ করছিলেন। এই মুখোশের ব্যাপারটা হঠাৎ করেই তার কাজের ভেতরে প্রবেশ করেছিল। তিনি একবার ভিয়োঁ কলম্বিয়েতে একটি দৃশ্যের মহড়া করছিলেন, সেই সময় তার এক অভিনেত্রী বারবার একই জায়গায় থেমে যাচ্ছিল এবং নড়াচড়া করতে পারছিল না – হয়তো তার রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, কোপ্যু এটা দেখে বেশ নিরাশ হয়ে পড়ছিলেন। এরপর তিনি হঠাৎ করে তাঁর রুমালটা দিয়ে অভিনেত্রীর মুখটা ঢেকে দেন এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অভিনেত্রীর শরীরটা কর্মক্ষম হয়ে ওঠে ও চমৎকারভাবে অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে থাকে, আসলে তার মুখটাই তাকে বাধা দিচ্ছিল। এই নিরীক্ষাটা পরে স্কুলের শিক্ষার্থীদের মধ্যেও প্রয়োগ করা হয়, এবং এ কাজে তখন ব্যবহার করা হতো মুখ ঢাকার মোজা বা কাপড়। কোপ্যু মুখোশ ব্যবহার করতেন তাঁর অভিনেতাদেরকে পারফরম্যান্সের সময়টাতে তাদের শরীরকে নিয়ন্ত্রণের সুবিধা দেওয়ার জন্য। তিনি গেইমস ব্যবহার করতেন, যেটা ছিল কেইথ জনস্টনের কাজের একটা পূর্বাভাস। কোপ্যুর তৈরি করা ‘আদর্শ মুখোশ’ পরবর্তীকালে নিরপেক্ষ অভিব্যক্তির মুখোশ তৈরির দ্বার খুলে দিয়েছিল, যেটা
হয়ে পড়েছিল লেককের সমার্থক। এই সমস্ত তত্ত্ব ও মিচেল ডেনিসের তত্ত্বই ইংরেজদের অভিনয় ঐতিহ্যের রূপান্তর ঘটিয়েছে, যা বর্তমানে অভিনেতাদের নাট্য প্রশিক্ষণের একটি মূল উপাদানে পরিণত হয়েছে।

৭. লেকক

জ্যাক লেকক মুখোশের ব্যবহার এবং অভিনেতাদের প্রশিক্ষণের ব্যাপারে কোপ্যুর ভাবনাগুলোকে আরো সমৃদ্ধ করেছেন। আর গর্ডন তাঁর দ্য পার্পাস অব পেস্নইং : মডার্ন অ্যাকটিং থিওরিস ইন পার্সপেক্টিভ গ্রন্থে লিখেছেন – পনেরো বছর ধরে ফ্রান্স ও ব্রিটেনে নাট্যাভিনয়, নির্দেশনা ও নাটক লেখার ক্ষেত্রে জ্যাক লেককের শিক্ষকতা উল্লেখযোগ্য প্রভাব রেখেছে। কিন্তু ইতিহাসের সবচেয়ে পরিহাসের ব্যাপারটা হলো, লেককের অনুপ্রাণিত থিয়েটার কোম্পানিগুলো, যেমন – লন্ডনের থিয়েটার ডি কমপিস্নসাইট ১৯৮০ ও ১৯৯০ সালের দিকে কোপ্যুর মৌলিক তত্ত্বগুলোকে আবারো প্রবর্তন করতে চেয়েছিল ব্রিটেনের নাট্যশিক্ষার ভেতরে, যেটা মিচেল সেইন্ট-ডেনিস ১৯৫০ ও ১৯৬০ সালের দিকে করতে চেয়েও পুরোপুরি সফল হতে পারেননি। লেকক নিজেই কোপ্যুর পদ্ধতিগুলো বিভিন্ন শিক্ষকের কাছ থেকে শিখেছিলেন, যাঁরা ভিয়োঁ কলম্বিয়ে বা কোম্পানি ডি কান্জের সদস্য ছিলেন।

লেকক দেখেছিলেন যে, মুখোশ একজন অভিনেতাকে মেকি স্বভাববাদ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে এবং একই সঙ্গে উদ্ভট ও বাস্তবতাকে বের করে আনতে পারে। মূল ব্যাপারটা হলো অভিনেতাটি যে চরিত্রে  পারফর্ম করছে, সে যেন সেটা সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন থাকতে পারে। একইভাবে এই সময়কার সুজুকি ও পিটার ব্রম্নকের চিন্তাভাবনার মতোই, লেকক অভিনেতাদের তাদের আদিম জৈব প্রকৃতির সঙ্গে পুনরায় যুক্ত করতে চেয়েছেন, আর এটার মাধ্যমে তাদের বোঝাতে চেয়েছেন যে তারা কোনোভাবেই একটা বিমূর্ত নিরীক্ষামূলক বস্ত্ত নয়। প্রশিক্ষণের শুরুতে অন্যতম যে ব্যাপারটার সঙ্গে লেকক তাঁর ছাত্রছাত্রীদের পরিচয় করিয়ে দিতেন সেটা হলো মুখোশের ব্যবহার, আর এটা ছিল পদ্ধতিগত এবং শিক্ষাগতভাবেই ইম্প্রোভাইজেশন ও নাটকেরই একটা অংশ। এ সম্পর্কে গর্ডনের ব্যাখ্যা :

মূলত অভিনেতাকে তার চারপাশের জগতের ভেতরে উন্মোচন করে দেয় মুখোশ। এটা তাকে উদ্ঘাটন, অসংকোচ এবং মুক্তিকে গ্রহণ করার মতো একটা অবস্থায় পৌঁছে দেয়। এটা তাকে শুরুর সতেজতাসহকারে আদি উপাদানগুলোকে দেখা, শোনা, অনুভব ও স্পর্শ করার সুযোগ দেয়। আপনি যখনই একটা নিরপেক্ষ অভিব্যক্তির মুখোশ পরবেন তখনই মনে হতে পারে যে, আপনি একটা চরিত্র গ্রহণ করছেন, কিন্তু আসলে আপনি কোনো চরিত্র গ্রহণ করছেন না, আপনি পরিণত হয়েছেন একটা নিরপেক্ষ সত্তায়।

লেককের শিক্ষণ প্রক্রিয়ার মূল ব্যাপারটাই ছিল নিরপেক্ষ অভিব্যক্তির মুখোশের ব্যবহার। লেকক ও আমলেতো সারতোরি নিরীক্ষামূলকভাবে চামড়ার তৈরি নিরপেক্ষ মুখোশ ব্যবহার শুরু করেছিলেন, যেটা বর্তমান যুগেও প্রশিক্ষণের সময় ব্যবহার করা হয়। তাঁদের দুজনের এই পদক্ষক্ষপটি চামড়া দিয়ে মুখোশ তৈরির ব্যাপারটিকে পুনরায় প্রবর্তনের পথ দেখিয়েছে। এই মুখোশগুলো অভিনয়-প্রশিক্ষণের জন্য বর্তমানে ব্যবহার করা হয়। এটা অভিনেতাদের শারীরিক কলাকৌশলের মাধ্যমে জ্ঞানার্জন করতে সহায়তা করে, যেটা তাদের মনস্তত্ত্বকেই নির্দেশ করে। লেককের ভাবনাগুলো ছিল আসলে মায়ারহোল্ডের ভাবনারই প্রতিধ্বনি। মৃত্যুর আগে লেকক শুধু প্যারিসের ভেতরেই সুপরিচিত ছিলেন, তবে মৃত্যুর পরে তাঁর কাজ নিয়ে লেখালেখি শুরু হতে থাকে এবং তাঁর লেখাগুলোও প্রকাশিত হতে থাকে, ফলে তিনি সারাবিশ্বের কাছেই অত্যন্ত পরিচিত হয়ে ওঠেন।

জ্যাক লেককের প্রভাববিসত্মারকারী পদ্ধতিগুলো বর্তমানে দেখা যায় মুভমেন্ট প্রশিক্ষণ এবং ইম্প্রোভাইজেশনের বিভিন্ন কাজের সংযোগকারী হিসেবে, যেটা অস্ট্রেলিয়ায় আরো একটু এগিয়ে নিয়ে গেছেন কেইথ জনস্টন এবং লিন পিয়ার্স তাঁদের থিয়েটার স্পোর্টসের কাজের মাধ্যমে। লেকক যেভাবে মুখোশ ব্যবহার করেছেন সেটার প্রভাব প্রচুর পরিমাণে পড়েছে নাট্য প্রশিক্ষণের ওপরে। সেইন্ট-ডেনিসের মতোই, যেটাকে তিনি বলেছেন ‘ফলিত কৌশল’, সেটা নিবিড়ভাবে লাবানের তত্ত্বের খুব কাছাকাছি মনে হলেও এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি যে লেকক লাবানের তত্ত্বগুলো সম্পর্কে জানেন, বরং লেককের তত্ত্বটা আসলে লেকক নিজেই তৈরি করেছেন। কমেডিয়া দেল আর্তে নিয়ে আট বছর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর লেকক নিজেই প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘লিকোল ইন্টারন্যাশিওনেল দে থিয়াত্রে জ্যাক লেকক’।

লেককের পদ্ধতিগুলো লাবানের পদ্ধতিগুলোর সঙ্গে মিলে যাওয়াটা খুব একটা আশ্চর্যের কিছু নয়। তিনি ‘অ্যাসোসিয়েশন ট্রাভেল এত্ কালচারে’ পারফরমার হিসেবে যোগ দেওয়ার আগে ছিলেন একজন ক্রীড়া শিক্ষক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ইতালিতে তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন এবং সে-সময় তিনি ফ্যাসিবাদবিরোধী দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন। মুখোশ নিয়ে এ সময়টাতেই তিনি অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন এবং তারপরে তিনি ১৯৫৬ সালে প্যারিসে চলে আসেন এবং সেখানেই তিনি তাঁর প্রথম স্কুলটা চালু করেন। ফিলিপ গোলিয়ে ও মনিকা পেগনিউকস ছিলেন তাঁর ছাত্র। শরীর নিয়ে কতভাবে খেলা যায় এবং কীভাবে এটাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, এসব নিয়ে তাঁরা তিনজন একত্রে কাজ করেছেন। পেগনিউকস অবশ্য পরবর্তী সময়ে পিটার ব্রম্নকের সঙ্গে কাজ করার জন্য সিআইআরটিতে চলে গিয়েছিলেন এবং এরপরে তিনি কমপিস্নসিটের সঙ্গেও কাজ করেছেন।

লেককের ক্রমাগত প্রভাব এবং কোপ্যু ও মায়ারহোল্ডের প্রচেষ্টা এবং সেইসঙ্গে আরো অনেকের প্রচেষ্টা, যাঁরা তাঁদের হৃদয়ে শারীরিক থিয়েটারকে ধারণ করেন, তাঁদের কারণেই থিয়েটারে শরীরকে ব্যবহার করার যে বিরোধিতা ছিল সেটা দূর হয়ে গেছে। কিফে ও মারি সম্পাদিত ফিজিক্যাল থিয়েটার্স : আ ক্রিটিক্যাল রিডারে এই বিকল্প ধারা সম্পর্কে একটা বর্ণনা পাওয়া যায় : লেকক, পেগনিউকস ও গোলিয়ে ‘প্রশিক্ষণে’র একটি বিকল্প ধরন উপস্থাপন করেছিলেন ‘পদ্ধতি’ ও ‘প্রণালী’ থেকে এবং তাদের অনুসারীরা নিজেদেরকে নিয়োগ করেছিল মনস্তত্ত্ব ও প্রেরণা নিয়ে কাজ করার দিকে : এটা এমন একটা ব্যাপার যেটা অত্যন্ত গভীরে অবস্থান করে, যেটা পাশ্চাত্যে অতটা পরিচিত নয়।

 

৮. আরিয়ান নুশকিন ও জুলি তাইমর

আরিয়ান নুশকিন ও জুলি তাইমর (তাঁরা দুজনেই ‘লিকোল ইন্টারন্যাশিওনেল দে থিয়াত্রে জ্যাক লেককে’ পড়াশোনা করেছেন), তাঁদের কাজগুলোই আসলে বর্তমানে মুখোশ নিয়ে বিভিন্ন পারফরম্যান্স ও প্রশিক্ষণ পদ্ধতির মূল প্রতিমূর্তি। তাইমরের কাজগুলোতে থাকে অসাধারণ এক নান্দনিক চিত্রকল্প। তাঁর সবচেয়ে সফল প্রযোজনা লায়ন কিংয়ে দেখা যায় মুখোশ ও আধ্যাত্মিকতার অত্যন্ত চমৎকার মিশ্রণ। তাইমরের কাজগুলো মায়ারহোল্ড ও ব্রেখটকেই মনে করিয়ে দেয়। আর তাঁর কাজগুলোতে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে চিত্রিত একটা সুচিমিত্মত কনস্ট্রাকটিভিস্ট স্টাইল থাকে, যেটা দর্শক গ্রহণ করেছেন এবং সমালোচকরাও পছন্দ করেছেন।

এ প্রসঙ্গে উইনস্কট ও ফ্লেচার মত :

তাইমর চেয়েছিলেন এমন একটা উপস্থাপনযোগ্য সেট, যেটা সেটের আরো কয়েকটি অংশের চলাচলে বাধা সৃষ্টি করবে না বা পাপেটগুলোকেও ঠিকমতো কাজ করতে দেবে। আর এর ফলে সৃষ্টি হয়েছিল একটা জাদুকরী পরিবেশনা। নুশকিন প্রচ-ভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছেন লেকক, কোপ্যু ও মায়ারহোল্ডের মাধ্যমে। আর এ কারণেই থিয়েত্রে দ্যু সোলেইয়ের পরিচালক থাকাকালীন সময়ে তিনি তাঁর প্রযোজনাগুলোতে প্রচুর পরিমাণে অদ্ভুত এবং কমেডিয়া স্টাইল ব্যবহার করেছেন। তাঁর এরকমই একটা প্রযোজনার নাম হলো ১৭৮৯। হজ বলছেন, ‘নুশকিন তাঁর সারা কর্মজীবনে দর্শক ও অভিনেতাদের মধ্যের বিনিময়কে পুনরুজ্জীবিত করার পথ খুঁজে গেছেন, আর এ কারণেই তিনি সমাজের প্রাসঙ্গিক ও একান্ত প্রয়োজনীয় বিষয়বস্ত্তগুলোকে বেছে নিয়েছিলেন।

নুশকিনের কাজগুলো আসলে পারফরম্যান্সের উৎসের দিকে দৃষ্টি দিত, নাটকীয়তার মাধ্যমে দর্শকদের মানুষের গল্প বলত। এক্ষেত্রে নুশকিনের উদ্দেশ্যের সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যায় বারবা, ব্রম্নক ও গ্রোটোস্কির প্রযোজনা সংক্রান্ত আদর্শের সঙ্গে। আর তাঁদের মতোই নুশকিন অনুপ্রাণিত হয়েছেন কমেডিয়া দেল আর্তের শারীরিক কলাকৌশল এবং বিশ্ব নাট্যচর্চার মাধ্যমে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপারটা হলো, নুশকিন নাট্যশিক্ষার একেবারে কেন্দ্রে রেখেছেন মুখোশের ব্যবহার। নুশকিনের প্রযোজনায় একজন অভিনয়শিল্পীর কোনো একটা চরিত্রকে ধারণ করার জন্য সেই চরিত্রটির শারীরিক কলাকৌশল ও শারীরিক সক্ষমতা অর্জন করতে প্রায় এক মাস লেগে যেত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নুশকিন কমেডিয়া দেল আর্তের মুখোশ এবং গ্রোটোস্কি ও মায়ারহোল্ডের শরীরবিষয়ক গবেষণালব্ধ ভাবনাগুলোকে সমন্বয় করার চেষ্টা করেছেন। এ বিষয়ে কিফে ও মারির মতামত :

বিশেষ করে নুশকিনের ক্ষেত্রে, সবসময়ই কথা ও কাজের মধ্যে একটা অঙ্গীকার ছিল : …উদ্ভাবনী ক্ষমতাকে কাজে লাগাতে হবে; থিয়েটারকে দেখতে হবে দৃশ্যগত, শরীরগত ও আন্ত্রিকগতভাবে, পুরোপুরি সাহিত্যের আলোকে নয়…থিয়েটারের একসময়কার ‘জনপ্রিয়’ এবং রাজনৈতিক এই উভয় ধরনকেই মনে রাখতে হবে; অভিনয় এবং পরিবেশনার জনপ্রিয় ধরনগুলোর মধ্যে রয়েছে – মুখোশ, ভাঁড় এবং সার্কাসের মতো কলাকৌশল। তিনি মুখোশের ব্যবহার প্রথম শুরু করেছিলেন তাঁর বহু আগের একটি কাজ কাপিতান ফ্রাকাসে নাটকে, সেখানে তিনি ব্যবহার করেছিলেন কমেডিয়া দেল আর্তের মুখোশ, পরবর্তী সময়ে লা এইজ ডি’ওর নাটকেও তিনি এই মুখোশ ব্যবহার করেছেন। এই নাটকে তিনি বামপন্থী রাজনীতিকে তুলে ধরেছিলেন এবং ফ্রান্সে রাজনীতির কারণে যারা দেশত্যাগ করেছিল তাদের কথা বলেছিলেন, আর এই কাজে তিনি ব্যবহার করেছিলেন ঐতিহ্যবাহী কমেডিয়ার চরিত্র। নুশকিন অনুপ্রেরণা লাভ করেছেন মায়ারহোল্ডের কাছ থেকে, বিশেষ করে তাঁর একটি প্রযোজনা ফেয়ারগ্রাউন্ড বুথ থেকে। নুশকিন ১৯৮০ ও ১৯৯০ সালের দিকে তাঁর আরো কয়েকটি প্রযোজনায় মুখোশের বিভিন্ন ফর্ম ব্যবহার করেছিলেন, বিশেষ করে সিহুক এবং দ্য ওরেস্টিয়া প্রযোজনা দুটোর কথা বলাই যায়। নুশকিনের ক্ষেত্রে নাটকের মহড়া ও প্রদর্শনী উভয় জায়গায়ই মুখোশের ব্যবহার ছিল অপরিহার্য। কর্মশালায় এবং ইম্প্রোভাইজেশনের সময় নুশকিন অভিনেতাদের সুযোগ করে দিতেন এমনভাবে, যেন তারা মুখোশটা ব্যবহার করে নিজেদের প্রকৃতভাবে উপস্থাপন করতে পারে। কস্টিউম ও মুভমেন্টের ক্ষেত্রেও তিনি অভিনেতাদের একই কথা বলতেন, যেন তারা যতটা ব্যবহার করতে পারবে ঠিক ততটাই যেন অভিনেতারা গ্রহণ করে, তার অতিরিক্ত কিছু নয়। অভিনেতারা তখন তাদের মতো করে সবকিছু ব্যবহার করে প্রযোজনাটির দৃশ্যগুলো তৈরি করত। তবে মূল বিষয়বস্ত্ত নির্ধারণ করে দিতেন নুশকিন নিজেই। নুশকিন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সংস্কৃতিকে যুক্ত করেছেন তাঁর টুয়েলফথ নাইট ও লে আত্রিদে নাটকে। এই ধরনের নাটক তৈরি করে ব্রম্নক ও বারবা’ও অনেক প্রশংসা অর্জন করেছেন এবং প্রভাবিতও করেছেন অন্যদের। ব্রম্নক ত্যাঁর আন্তসাংস্কৃতিক ভাবনাগুলো তুলে ধরেছেন তাঁর দ্য বার্ডস এবং দ্য মহাভারত নাটকে। তবে এক্ষেত্রে একটু তর্ক হতে পারে যে এই নাটকগুলো যতটা না আন্তসাংস্কৃতিক ভাবনা আশ্রিত, ততটাই আসলে একটা সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। যাই হোক, একাধিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি এবং বিশেষ করে এই ধরনের প্রযোজনায় মুখোশের ব্যবহারটা আরেকটি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যেতে পারে যে এটি আসলে একটি অপশ্চিমা সংস্কৃতিরও বৈধতার স্বীকৃতি, যেটা নিজ ও অন্যের মধ্যের সম্পর্কটা নিয়ে অত্যন্ত বিসত্মৃতভাবে আলোচনার সুযোগ করে দিচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের সংস্কৃতি-আশ্রিত মুখোশের বিভিন্ন ফর্ম ব্যবহার করাটা অভিনয়শিল্পী ও দর্শকদের ক্ষেত্রেও আত্ম-প্রতিফলনের একটা সুযোগ তৈরি করে দেয়। উলিস্নখিত নাট্য নির্দেশকেরা পারফরম্যান্স ও মহড়ায় মুখোশের ব্যবহার করে নাট্য সমালোচকদের চোখে বহুলভাবে প্রশংসিত হয়েছেন এবং নাট্যপ্রক্রিয়া ও নাট্য প্রযোজনার ক্ষেত্রে আদর্শ হয়ে আছেন।

এটা খুব স্পষ্ট যে বিশিষ্ট এবং সৃজনশীল নাট্য নির্দেশকরা সবসময়ই তাঁদের কাজের মধ্য দিয়ে এটা প্রমাণ করেছেন যে, মুখোশ শুধু আধুনিক যুগের অভিনেতাদের প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রেই প্রাসঙ্গিক নয়, বরং এটা প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়াকেও সমৃদ্ধ করে। একবিংশ শতাব্দীতে গণমাধ্যম ও বিনোদনের অন্যান্য মাধ্যমের ক্রমাগত চাপের মুখেও যদি থিয়েটার চর্চাকে প্রাসঙ্গিক করতে হয়, তাহলে আমাদেরকে একটু অতীতের দিকে তাকাতে হবে, আর তাহলেই আমরা ভবিষ্যতের পথটা খুঁজে পাব এবং অব্যাহতভাবে থিয়েটারে নতুন নতুন উপাদান যোগ করতে পারব ও এটাতে নতুনভাবে শক্তি সঞ্চার করতে পারব। আর মুখোশই এটা সম্ভব করে তুলবে। শারীরিক থিয়েটার নিয়ে যাঁরা লেখালেখি করেন, যেমন, জোনাথন পিচেস, মেল গর্ডন এবং আরো অন্যান্য লেখকের লেখা নিয়ে জন কিফি ও সাইমন মারি একটি বই লিখেছেন ফিজিক্যাল থিয়েটার্স : আ ক্রিটিক্যাল রিডার নামে। এটা খুব মজার যে, এই বইটার বেশিরভাগ লেখাই কোপ্যু ও লেককের ছাত্রছাত্রীদের কেন্দ্র করেই, কিংবা বলা যায় লেখাগুলো মুখোশকে অভিনেতা তৈরির মাধ্যম হিসেবে তুলে ধরার একটা বহিঃপ্রকাশ।

তবে একবিংশ শতাব্দীর প্রযোজনাগুলোর জন্য নাট্য প্রশিক্ষণের একটা মাধ্যম হিসেবে মুখোশের গভীরতা বা আবেদন আসলেই কতটা আছে? লক্ষ করে দেখা গেছে যে, বিংশ শতাব্দীর অনেক বিখ্যাত নাট্য নির্দেশক নাট্য প্রযোজনা ও নাট্য প্রশিক্ষণের জন্য প্রচুর মুখোশ ব্যবহার করেছেন। সুতরাং এসব বিবেচনা করেই বলা যায় যে, পরবর্তী প্রজন্মের নাট্যকর্মী এবং নাট্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এখনই উচিত হবে একবিংশ শতাব্দীর অত্যন্ত সৃজনশীল ও প্রতিযোগিতামূলক থিয়েটারের জন্য মুখোশকে একটা অভিনয় মাধ্যম হিসেবে পুনঃপ্রবর্তন করা এবং সেটাকে নিয়মিত ব্যবহার করা।

সমাপ্তিকথন
এতক্ষণ ধরে আমি বিশ^ তথা পাশ্চাত্য থিয়েটারের মধ্যে মুখোশকে সঙ্গে নিয়ে ঘোরাফেরা করলাম, বলার চেষ্টা করলাম থিয়েটারের নানারূপের মধ্যে কীভাবে এর বসবাস, নানাভাবে এর ব্যবহার ও প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরলাম। ভিন্ন ভিন্নভাবে এর প্রয়োগের ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করলাম। কেন এবং কীভাবে পৃথিবীর, বিশেষ করে পাশ্চাত্যের নাট্য নির্দেশক ও পারফরমাররা এর কৌশলটাকে রপ্ত করার পাশাপাশি একে ব্যবহার করে তাঁদের শৈল্পিক কাজগুলোকে অর্থপূর্ণ করে তুলেছেন : কখনো তাঁরা মুখোশকে নাট্যক্রীড়ার একটা কৌশল হিসেবে ব্যবহার করেছেন; কখনো বা সিনিক ডিভাইসের অংশ হিসেবে ব্যবহার করে নাট্য প্রকাশের ভাষার একটা অতিরিক্ত মাত্রা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন; কখনো বা মুখোশকে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে ব্যবহার করেছেন; কখনো আবার সমাজের ক্ষমতাসীন চরিত্রগুলোকে ব্যঙ্গাত্মকভাবে দর্শকের মাঝে হাজির করেছেন, কমেডিয়া দেল আর্তের অনুকরণে। কখনো বা রাষ্ট্রযন্ত্রের বাক্স্বাধীনতার নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার ‘অনুমোদন-আধিকারিক কর্ম’কে আড়াল করার লক্ষক্ষ্য। কখনো বা ব্যবহার করেছেন অভিনয়ের উৎকর্ষ সাধনের জন্যে বা অভিনয়ের পদ্ধতিগত প্রশিক্ষণের কাজে।

নানাভাবে নানাধারায় সেই প্রাচীন যুগের থিয়েটার থেকে একেবারে সমকালীন থিয়েটারে বহুমাত্রায় মুখোশের প্রয়োগশৈলী আমরা দেখতে পেলাম, দেখতে পেলাম মুখোশ কী করে তার নিজস্ব শক্তি বলে নিজেই একটা স্বতন্ত্র্য শিল্পমাধ্যম হয়ে ওঠে।

একজন বিশ্ব থিয়েটারের কর্মশীল পরিব্রাজক হওয়ার কারণে আমাকে ঘুরতে হয়েছে, কাজ করতে হয়েছে এশিয়া, আফ্রিকা, ক্যারিবিয়া, লাতিন আমেরিকা, উত্তর আমেরিকা থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ও সংস্কৃতির মধ্যে। মুখোশনির্ভর নানা দেশের পারফরম্যান্সের মুখোমুখি হতে হয়েছে। এটা আমার বিশ^াস যে আমার থিয়েটারের শিল্পকৌশল ও অভিব্যক্তি  সম্পর্কে যাদের কিছুটা ধারণা আছে নিশ্চয়ই তাঁদের মানসপট থেকে এর প্রয়োগের কৌশল ও প্রতিচ্ছবি মুছে যায়নি। প্রসঙ্গক্রমে আমাকে বলতেই হচ্ছে, আমি থিয়েটারে মুখোশের ব্যবহার করি মুখের ভাষার অতিরিক্ত প্রতীকী ব্যঞ্জনা বা রূপক আকারে। এটা আমার আর্টিস্টিক এক্সপ্রেশন তৈরির একটা কৌশল, যেটাকে বলা যায় পলিটিকস ইন এসথেটিকস বা কামিত্মবাদের রাজনীতি। যেহেতু আমার শিল্পকর্মের বসবাস রাজনৈতিক থিয়েটারের মধ্যে আর সে কারণেই এ নাট্য উপকরণটি হয়ে উঠেছে আমার নাট্যভাষার একটা অতিরিক্ত উপকরণ, যে উপকরণের সাহায্যে আমি সমকালীন রাজনীতির গুপ্তভাষাকে (যেটা সাধারণত খোলা চোখ প্রত্যক্ষ করতে ব্যর্থ হয় বা জনমানুষের কাছ থেকে গোপন করা হয়) উন্মোচনের চেষ্টা করি, যাতে দর্শক এই উপকরণের মধ্য দিয়ে রাজনীতি তথা কর্তৃত্বব্যঞ্জক রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার নিয়ম ও অনিয়মের বিভ্রামিত্মকর হাজারো অর্থকে নিজের মতো করে খুঁজে নিতে পারে। এটা আমাদের ভুললে চলবে না যে, মুখোশের স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য ও শক্তি হচ্ছে বাস্তব ও রূপকের পারস্পরিক সম্পর্ক। যে কারণে আমি আমার অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি মুখোশের সহযোগিতায় সকল নাট্যক্রিয়া হতে পারে অবাধ ও স্বাধীন। এটা একদিকে যেমন মনোরঞ্জক, অন্যদিকে তেমনি অর্থপূর্ণ কৌশলও। আর যে কারণেই একে দমন করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। সম্ভব নয় বলেই বিশ^ রাজনৈতিক থিয়েটারের নির্দেশকদের যোগাযোগের অন্যতম বাহনই হচ্ছে মুখোশ। প্রসঙ্গক্রমে আমাকে দেশ-কালের প্রেক্ষাপটে মুখোশের রাজনৈতিক ব্যাখ্যাটা দাঁড় করাতে গিয়ে বলতেই হচ্ছে :

আমরা এমন এক সময়ের মধ্যে আটকে পড়েছি যখন আমাদের মুখগুলো ঢেকে রেখেছে বিচিত্র সব রঙের মুখোশ এবং এদেরকে সঙ্গে নিয়ে আমরা হেঁটে চলেছি অদ্ভুত এক সময়ের মধ্যে। এটা এমন এক সময় যখন মুখোশ আমাদের শরীরের চামড়ার সঙ্গে আটকে পড়েছে, শরীরের চামড়া না ছাড়ানো অবধি এ মুখোশ কখনোই খুলে ফেলা সম্ভব নয়।

প্রশ্ন আসাটা স্বাভাবিক, কেন? আমাদের থিয়েটারে মুখোশের গুরুত্ব কতখানি, আর কেনই বা এটাকে নিয়ে বারবার কথা বলছি? আজকের থিয়েটারের চর্চা ও প্রযোজনার ক্ষেত্রে বা থিয়েটার শিক্ষা কার্যক্রমে মাধ্যম হিসেবে মুখোশের গভীরতা বা প্রয়োজনীয়তা কতটা আছে, এর উত্তর আমি খুব জোরের সঙ্গেই বলছি বর্তমানকালের বিশ^ তথা দেশের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে মুখোশ আমাদের ভবিষ্যৎ থিয়েটারের প্রধান ও অন্যতম বাহন হয়ে উঠবে। আজ আমরা এমন একটা দেশ-কালের মধ্যে ঢুকে পরেছি যেখানে থিয়েটারকে রাজনীতির মুখোমুখি হতে এই বাহনটি শক্তিশালী রূপক হিসেবে কাজ করবে। কাজ করবে একটি বিকল্পধারার থিয়েটার তৈরি করতে। আমরা যদি জ্ঞানতত্ত্ব ও দর্শনের চোখ দিয়ে দেশের রাজনীতির একটা বিশেস্নষণাত্মক উপসংহারে পৌঁছোতে চাই, তবে এটা বলতেই হয় যে দেশ ও জাতির সামনে অপেক্ষা করছে চূড়ান্ত সংঘর্ষ। যেটাকে আমরা সভ্যতার সংঘর্ষ বলতে পারি।

 

আমাদের আজকে বুঝতে হবে যে সংস্কৃতির রূপ বা অবয়ব এই সংঘর্ষের কেন্দ্রবিন্দুর মূল-তর্ক হয়ে উঠছে এবং ভবিষ্যতেও উঠবে। সংস্কৃতির সেই রূপের মধ্যেই বসবাস আমাদের অসিত্মত্বের, আমাদের জাতীয়তাবাদের। যার সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে বাঙালি জাতিসত্তা(?)! আমাদের বুঝতে হবে যে বাংলাদেশের সমকালীন রাজনীতির ঝড়ো বাতাস ঢুকে পড়েছে এবং পড়ছে চরম দক্ষক্ষণবলয়ের মধ্যে। যে রাজনীতির এপিসেন্টারে ঘাপটি মেরে আছে পুঁজি, ধর্ম, গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ; আর সেই কারণে এই সমাজের অসাম্প্রদায়িক শরীর আজ রক্তাক্ত। এ যেন শেক্সপিয়ারের কিং লিয়ার নাটকের সংলাপ :                            

যখন পাগল অন্ধকে পথ দেখায়,
তখনই মহামারিতে আক্রান্ত হয় সময়!
এটা আমাদের মানতেই হবে যে গণতন্ত্রের বল মধ্যবিত্তের হাত থেকে ছুটে বেরিয়ে পড়েছে! গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও মোল্লাতন্ত্র এখন পুঁজির মধ্যে মিলেমিশে একাকার হয়ে পড়েছে। এ্যালেন বদিউর ভাষায় বলতে হয়, জনগণ এখন শ্রেণিতে বিভক্ত, শ্রেণি এখন রাজনৈতিক নেতাদের অধীনস্ত এবং রাজনৈতিক দলগুলো এখন এক নেতার হুকুমে চালিত। ফলে সংঘর্ষ অবশ্যসম্ভাবী হয়ে পড়েছে বিবেকবর্জিত রঙ্গমঞ্চে! পালার চরিত্র রবি ঠাকুরের দাদা ঠাকুর আর সুরে গান গাইবে না, গান বাঁধবে না খ্যাপা বাউল ত্রিদিব দসিত্মদার –

 নোংরা ভূমিতে উড়ছে পতাকা
ঢাকের শব্দ ঢেকে যায় আমাদের দুর্বোদ্ধ কথাবার্তায়
শাসনযন্ত্রের কেন্দ্রে প্রতিপালন করবো
নৈরাশ্যের গণিকাবৃত্তি

বিদ্রোহের রক্তে ভাসবো আমরা! 

আমি ভীত নই কিন্তু শঙ্কিত। শঙ্কিত দেশের রাজনীতির নতুন জাদুর বাক্স নিয়ে। যে জাদুর বাক্সে বন্দি হয়ে পড়েছে নৈতিকতা ও অনৈতিকতা। প্রিয় কবি ও নাট্যকার ভিক্টর হুগো বেশ জমপেশ একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছিলেন এ প্রসঙ্গে :

নৈতিকতা একটা ছদ্মবেশ,

অনৈতিকতা – মুখোশ।

হুগোর ব্যাখ্যার প্রথমটিতে বিরাজ করছে উত্তর-রাজনৈতিক যুগ আর দ্বিতীয়টিতে অবস্থান করছে উত্তর-সত্য যুগ, যার রং ধূসর। এ যেন এডওয়ার্ড এলগারের মিউজিক্যাল স্কেচ দি অ্যানিগমা ভ্যারিয়েশনে প্রতিধ্বনি –

সকল কিছুই সত্য,

এবং কোনো কিছুই সত্য নয়! 

এখন প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক যে এই রকম বিভ্রামিত্মমূলক রাজনৈতিক অবস্থার মধ্যে আদৌ কি আমরা আমাদের জীবন্ত শিল্পমাধ্যমগুলোকে বাঁচাতে পারব? আর বাঁচাতে পারলেও এর স্বরূপটাই বা কেমন হবে? এই প্রশ্ন শুধু আমাদের নয়, সারাবিশে^র থিয়েটার ফর্ম তথা লিভিং আর্ট ফর্মের বিভিন্ন শাখার শিল্পীদের কাছে, যেহেতু পৃথিবী আজ আক্রান্ত :

 

স্বাগতম, রক্তাক্ত ধ্বংস-সংহার

আমি দেখি, মানচিত্রে, সমস্ত কণার বিনাশ! 

বিশ^সভ্যতা যখন সংকটে তখন কি থিয়েটার নিশ্চুপ থাকবে? নাকি তার আপন শক্তি নিয়ে বায়োপলিটিকসের মুখোমুখি হবে?

পাঠকের মন্তব্য Login Registration