পার্থ প্রতিম মজুমদার

প্রতিনিধি | শ্রদ্ধাঞ্জলি

শনিবার ১৮ মে ২০১৯|১৩:৩৮:২৭ মি.


আনুষা ইসরাত শেখ

আদিম যুগে সংকেত এবং ইশারার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে যোগাযোগ করা হত। যখন মানুষ তাদের কণ্ঠস্বর ব্যবহার করতে শুরু করে, এই মৌন ইশারা যোগাযোগের প্রধান মাধ্যমে হিসেবে আর ব্যবহৃত হয়নি। কিন্ত এগুলো পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি। এগুলো শিল্পরুপে বিকশিত হয়, হাজার হাজার মানুষকে আনন্দ দিয়েছে এবং মূকাভিনয় হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। মূকাভিনয় এক ছোট বালকের হৃদয় ছুয়ে গিয়েছিল যখন তিনি তাঁর গ্রামে একটি পরিবেশনা উপভোগ করেছিলেন। পরিবেশনায় তিনি এতই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে এই শিল্পে দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। তিনি পার্থ প্রতিম মজুমদার। বাংলাদেশে মূকাভিনয়ের জগতে পার্থ নিঃসন্দেহে একজন অগ্রপথিক। তিনি একজন সংগীত শিল্পী হিসেবে কর্ম জীবন শুরু করেন। ছন্দ সম্পর্কে গভীর অনুভূতি তাঁকে তাঁর অঙ্গগুলোকে আন্দোলিত করতে এবং ইশারার মাধ্যমে তাঁর চারপাশকে প্রকাশ করতে সাহায্য করেছে। পার্থ প্রতিম মজুমদারই প্রথম বাংলাদেশি, যিনি মূকাভিনয়কে পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন। বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি টেলিভিশন প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন তিনি এবং জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। মজুমদার মূকাভিনয়ের মাধ্যমে মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে তুলে ধরেন। সেখানে যেমন থাকত দুঃখ, অশ্রু তেমনি সুখ আর হাসিও থাকত। ১৯৭৯ সালে মজুমদারে জীবনের দিক পরিবর্তনের সময় আসে যখন তাঁকে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে একটি একক পরিবেশনার জন্য বলা হয়। তখনকার ফ্রান্সের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত লয়িক মুর‌্যে ঘটনাক্রমে দর্শকদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন। জনাব মুর‌্যে মজুমদারের মাঝে মেধা লক্ষ্য করেন। ১৯৮১ সালে ফ্রান্স সরকার তাঁকে একটি বৃত্তির প্রস্তাব দেয় যাতে করে তিনি মূকাভিনয়ের ওপর পেশাগত প্রশিক্ষণ পেতে পারেন। এটিই প্রথম যে, মূকাভিনয়ে ফ্রান্স একজন ছাত্রকে বৃত্তি মঞ্জুর করে। কিংবদন্তী ওস্তাদ ইটিনি ডেক্রোর অধীনে মুজমদার তাঁর প্রশিক্ষণ শুরু করেন। ডেক্রোর মাধ্যমে তিনি অন্য একজন বিখ্যাত মূকাভিনয় শিল্পী মার্সেল মার্সিউ-এর সাক্ষাৎ লাভ করেন। মার্সিউ মূকাভিনয়কে এক অকল্পনীয় উচ্চতায় নিয়ে গিয়ে একে আধুনিক মূকাভিনয়ের রূপ দান করেছেন। বাংলাদেশি যুবকের প্রতিভায় মার্সিউ খুব মোহিত হন এবং মূকাভিনয়ের জন্য তাঁর প্রতিষ্ঠিত ইকোল ইন্টারন্যাশনাল ডি মাইমোড্রেইম ডি প্যারিস মার্সেল মার্সিউ নামক বিদ্যালয়ে প্রশিক্ষণের প্রস্তাব দেন। মূকাভিনয়ের এই বিদ্যালয়টি পৃথিবীর মধ্যে বৃহত্তম ও শ্রেষ্ঠ। তিন বছরের প্রশিক্ষণের সময়ে, মজুমদার ১৬-১৮ ঘন্টা অনুশীলন করতেন যতক্ষণ না তার এমন মনে হত যে, শরীরের প্রত্যেকটি হাড় ভেঙে যাচ্ছে। মার্সিউর সাথে কাটানো এই সময়ের পর মজুমদারকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তিনি ইংল্যান্ড, বেলজিয়াম, জার্মানি, স্পেন, ইতালি এবং আমেরিকায় একক অভিনয় করেন। ফ্রান্স, কানাডা এবং আমেরিকার টিভি চ্যানেলগুলো উৎসাহের সাথে তাঁর পরিবেশনাসমূহ সম্প্রচার করেছিল। ২০০৯ সালে, জনপ্রিয় ফরাসি নাটকে অভিনয়ের জন্য মজুমদার “মলিরি পুরষ্কার” লাভ করেন যেটি হলো ফরাসি নাট্যশালায় সর্বোচ্চ পুরষ্কার। মূকাভিনয় শিল্পের পথপ্রদর্শক হিসাবে এবং বাংলাদেশে এ শিল্প ধারাকে জনপ্রিয় করার জন্য ২০১০ সালে বাংলাদেশ সরকার এই শিল্পীকে দেশের সর্বোচ্চ পুরষ্কার “একুশে পদক” প্রদান করেন। ২০১১ সালে ফরাসি সরকারও বিশ্বব্যাপী মূকাভিনয়ে অবদানের জন্য তাঁকে “চেভ্যালিয়ার ডি আই অড্রি ডেস আর্টস এট ডেস লেটারস” (শিল্প ও সাহিত্যে নাইট) নামে ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সাংস্কৃতিক পদক প্রদান করেন।

 

 

পাঠকের মন্তব্য Login Registration