ভক্তি ও প্রেরণায় কবি রজনীকান্ত সেন

প্রতিনিধি | শ্রদ্ধাঞ্জলি

শুক্রবার ২৭ জুলাই ২০১৮|১৫:০০:১২ মি.



ইফতেখার ইফতি
বাংলার পঞ্চকবির এক কবি রজনীকান্ত সেন। গানের মাধ্যমেও যে স্রষ্টার আরাধনা করা যায়, তার অনন্য নিদর্শন তৈরি করেছেন তিনি। ভক্তিমূলক গানকে নিয়ে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায়। বাংলার নবজাগরণের সময়কার এ কবির গানের উপজীবিকা ছিলো ঈশ্বরের স্তুতি ও স্বদেশ প্রেম।

রজনীকান্ত সেনের গানগুলো শুনলে হয়তো মনে হবে তার জীবন ছিলো কতই না সহজ ও সাবলিল। কঠিন যন্ত্রণাদায়ক গলার ক্ষতজনিত ক্যান্সারে কবির মৃত্যু হয়। অথচ কবির রোজকার ডায়রিতে ব্যাধিজনীত যন্ত্রণার কোনো উল্লেখ নেই।

মৃত্যুর আগে যন্ত্রণায় কাতর কবির ডায়রিতে যা পাওয়া গেছে তার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হলো, ‘দয়াল, আর একদিন, আর একদিন কণ্ঠ দে, দেবতাকে দেবতার গান শোনাই, আরেকটু কণ্ঠ দে দয়াল, শুধু ওকেই শোনাবো, তার পর এ কণ্ঠ বন্ধ করে দিস দয়াল।’

২৬ জুলাই ১৮৬৫ সালে সিরাজগঞ্জের ভাঙাবাড়িতে কবির জন্ম। পিতা গুরুপ্রসাদ সেন ও মাতা মনোমোহিনী দেবীর ৩য় সন্তান ছিলেন তিনি। গুরুপ্রসাদ চারশো বৈষ্ণব ব্রজবুলি কবিতাসঙ্কলনকে একত্রিত করে ‘পদচিন্তামণিমালা’ নামক কীর্তন গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এছাড়াও ‘অভয়াবিহার’ গীতি-কাব্যের রচয়িতা ছিলেন তিনি। ১৮৭৫ সালে রজনীকান্তের পিতা বরিশালের সাব-জজ পদ থেকে অবসর নেন।

ছোটবেলায় দুরন্ত ছিলেন কবি, সাধারণ ছেলেদের চেয়ে আলাদা। পড়ালেখা করতেন না একদমই। দুরন্তপনা করেই কাটিয়েছেন। সে বিষয়ে তিনি তার রোজনামচায় লিখেছিলেন, ‘আমি কখনও বইপ্রেমী ছিলাম না। অত্যন্ত কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফলের জন্যে ঈশ্বরের কাছে আমি কৃতজ্ঞতা জানাই।’

শৈশব থেকে রজনীকান্তের অসাধারণ একটি গুণ ছিলো, যে কোনো গান শুনেই তার সুর, তাল আয়ত্ত করতে পারতেন। মাত্র ১৫ বছর বয়েসে কালি সঙ্গীত রচনার মাধ্যমে তিনি অসাধারণ কবিত্বের পরিচয় দেন।

ইংরেজদের বিরুদ্ধে বরাবরই সোচ্চার ছিলেন কবি। স্বদেশী আন্দোলনে তার গান ছিল অসীম প্রেরণার উৎসস্থল। ৭ আগস্ট, ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে কলকাতার টাউনহলে একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিলাতী পণ্য বর্জন এবং স্বদেশী পণ্য গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন বাংলার প্রখ্যাত নেতৃবর্গ।

ভারতের সাধারণ জনগণ বিশেষতঃ আহমেদাবাদ এবং বোম্বের অধিবাসীগণ ভারতে তৈরি বস্ত্র ব্যবহার করতে শুরু করেন। কিন্তু এ কাপড়গুলোর গুণগতমান বিলাতে তৈরি কাপড়ের তুলনায় তেমন মসৃণ ও ভাল ছিল না। এর ফলে কিছুসংখ্যক ভারতবাসী খুশী হতে পারেননি। এই ভারতীয়দেরকে ঘিরে রজনীকান্ত রচনা করেন তার বিখ্যাত দেশাত্মবোধক ও অবিস্মরণীয় গান –

‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নেরে ভাই;
দীন দুঃখিনী মা যে তোদের তার বেশি আর সাধ্য নাই৷’

কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের দ্বার প্রভাবিত রজনীকান্ত এক সময় হাসির গান লেখা শুরু করেন। রজনীকান্ত সেনের গানগুলোকে বিষয়বস্তু অনুযায়ী ৪ শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে। দেশাত্মবোধক, ভক্তিমূলক, প্রীতিমূলক ও হাস্যরসের গান।
তার রচনাবলীর মধ্যে বাণী (১৯০২), কল্যাণী (১৯০৫), অমৃত (১৯১০) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
রজনী বিশ্বাস করতেন যে, ঈশ্বর তাকে ব্যথা-বেদনা দিয়ে তার পবিত্র আত্মাকে শুদ্ধ করছেন। এ বিশ্বাসটুকু তার অন্তঃশক্তি প্রদান করে শারীরিকভাবে ব্যথা থেকে সাময়িক বিমুক্ত রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। তাকে আত্মনিমগ্ন রেখে এ গান রচনা করতে সাহায্য করেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উৎসর্গ করে রজনীকান্তের একটি গান হলো,
‘আমায় সকল রকমে কাঙ্গাল করেছে, গর্ব করিতে চূর,
তাই যশ ও অর্থ, মান ও স্বাস্থ্য, সকলি করেছে দূর৷
ঐ গুলো সব মায়াময় রূপে, ফেলেছিল মোরে অহমিকা-কূপে,
তাই সব বাধা সরায়ে দয়াল করেছে দীন আতুর’

তারপর তিনি গানটিকে কবিতা আকারে বোলপুরে রবীন্দ্রনাথের কাছে পাঠিয়ে দেন। উষ্ণপ্রকৃতির এ কবিতা হাতে পেয়ে রবিঠাকুর ৩০ জুলাই একটি চিঠি লেখেন তাতে তিনি রজনী’র ব্যাপক সাহিত্য প্রতিভা এবং গৌরবময় ভূমিকার কথা সবিশেষভাবে উল্লেখ করেন। এর মাধ্যমেই তার অন্তরাত্মা শক্তি ও সাহস জুগিয়ে সর্বপ্রকার ব্যথা-বেদনা থেকে মুক্ত থাকবে বলে ব্যক্ত করেন।

‘আমি অকৃতি অধম ব’লেও তো কিছু কম করে মোরে দাওনি’ প্রচণ্ড ব্যথা ভরা অসুস্থ জীবনে অর্থকষ্টে থেকেও সৃষ্টিকর্তার প্রতি কবির কত যে কৃতজ্ঞতা, আরাধনা তা মানবজাতির জন্য নজির হয়ে থাকবে।

মাত্র ৪৫ বছর বয়সে ১৯১০ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর যন্ত্রণাদায়ক ক্যান্সার কেড়ে নেয় বাঙালী নব জাগরণের এই মহান কবিকে। কিছু মৃত্যু হয়তো দেহান্তরতুল্য, বাঙালী জাতির মাঝে বেঁচে রইবেন বিপ্লব, দেশপ্রেম আর ভক্তির গানে।-চ্যানেল আই

পাঠকের মন্তব্য Login Registration