ভ্রম

প্রতিনিধি | শিক্ষা

শনিবার ৪ আগস্ট ২০১৮|১৮:৩৩:১২ মি.



আজিম হিয়া

বাইরে প্রচন্ড ঝড় হচ্ছে। বৃষ্টিও। বৃষ্টির ফোঁটা জানালা দিয়ে আমার মুখের ওপর পড়ছে। ধীরে ধীরে আমার ঠোঁট দুটি ভিজে ওঠলো। আমি বিছানা ছেড়ে ওঠে বসলাম। জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালাম। দেখে মনে হলো ঝড় এবং বৃষ্টির মধ্যে এক ধরনের দ্বন্দ্ব চলছে। আর আকাশটা যেন ধুলো-বালি-জঞ্জালসহ গুমোট-কালো একটা কুন্ডলী পাকিয়ে এদিকে ধেয়ে আসছে। দেখতে ভালো লাগছে না আমার। আমি জানালাটা বন্ধ করে দিলাম। প্রকৃতি তার আপন বৈভবে খেলুক, নাচুক, মাতাল হোক। 
আমার মনে পড়ছেÑএই জানালা দিয়েই তো একটা পরিষ্কার আকাশ দেখে আমি ঘুমিয়েছিলাম; সেটা কত সময় আগে বা কতদিন ঠিক মনে পড়ছে না। বৃষ্টির অজস্র ফোঁটা জানালার কাচের ওপর আঁচড়ে পড়ছে। বুঝতে পারছি অসহায় এই বৃষ্টি যেন আমার ঘরেই আশ্রয় খুঁজছে। পৃথিবী অস্তিত্বের সংকটে পড়ে আমার জানালায় তার অশ্রু পাঠিয়েছে। আমার অন্য আরেক দিনের বৃষ্টির কথা মনে পড়ছে। সেদিন কোন ঝড় হয়নি। শুধুই বৃষ্টি হয়েছিল। অনেক নিবিড় বৃষ্টি। কী সুন্দর সেই বৃষ্টি! যেন সমস্ত আকাশ হাসছিল। আমার জানালা খোলা ছিল। আমি তন্ময় হয়ে দেখেছিলাম সেদিন। বৃষ্টিতে ভিজেও ছিলাম। সেটা কতদিন আগে, ঠিক মনে নেই।
আমি জানালা থেকে চোখ নামিয়ে বিছানার দিকে তাকালাম। আশ্চর্য! বিছানার কোথাও একফোঁটা বৃৃৃৃষ্টি পড়েনি। এমনকি আমার মাথা বা শরীরের অন্য কোন অংশেও না। বিছানা থেকে নেমে দ্রুত আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। সমস্ত আয়না জুড়ে মানুষের মুখের একটা অবয়ব দেখতে পেলাম। অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে আছি। কিন্তু এর মাথামুন্ডু কিছুই চিনতে পারছি না। কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে গেলাম। মাথার ভেতর অজস্র চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। কেন এমন হচ্ছে? কেনই-বা ছবির এই মানুষটাকে আমি চিনতে পারছি না? কোন এক-সময় কি তাকে চিনতাম? কিছুই মনে করতে পারছি না। মাথাটা খুব ভারী হয়ে আসছে। এক ধরনের যন্ত্রণা অনুভব করছি। কে যেন আমার সমস্ত অস্তিত্ব ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে গোড়াসুদ্ধ নাড়িয়ে দিচ্ছে। আমার খুব তৃষ্ণা পাচ্ছে। অসম্ভব তৃষ্ণা। এ এক অন্য রকম তৃষ্ণা। আমি আমার ডান হাতের তর্জনী মুখে পুড়ে চুষছি পরীক্ষার হলে প্রশ্নের সঠিক উত্তর মনে করতে না পেরে কলমচোষার মতো। ইচ্ছে করছে আয়নার কাচটাতে সজোরে বেশ ক’টা ঘুষি মারি। জীবনের এতো এতো জট দেখতে ভাল লাগছে না। কীসের এতো রহস্য? ছোট্ট জীবনে এতোসব পাওয়ারফুল কান্ডকারখানা ঠিক যেন সরু তারের ভেতর দিয়ে হাজার হাজার ভোল্টেজের বিদ্যুৎ প্রবাহের মতো। হ্যাঁ! বিদ্যুতের তারের সাথে জীবনের অনেক মিল আছে বটে। অন্তত এই মুহূর্তে আমার এমনই মনে হচ্ছে; রাস্তার পাশে থামের সাথে প্যাঁচানো তারের জটলার মতোই বিরক্তিকর। হ্যাঁ। আমি তাকে চিনতে পারছি না। তাতে কী? এই একটা মানুষকে চিনতে না-পারাটা দোষের কিছু না। পৃথিবীর সব মানুষকে তো আমার চিনে রাখার কথা না। কোন মানুষই তা পারে না। এবার সংশয় ঠেলে আত্মবিশ্বাসের বুদ্বুদ ওঠছে। আমি আমার পরিচিত কোন মুখ মনে করার চেষ্টা করছি। তেমন কাউকেই মনে পড়ছে না। যতই আমি আরো দৃঢ় এবং সুক্ষ্মভাবে চেষ্টা করছি, ততই যেন আমার সবকিছু আরো দ্রুত তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। না, পরিচিত কোন মুখ আমি মনে করতে পারছি না। এবার আমার মনে হতে লাগল পৃথিবীর কোন মানুষকেই আমি চিনি না। এমনকি নিজেকেও না। কোন একসময় কি চিনতাম নিজেকে কিংবা অন্য কাউকে? আচ্ছা, অন্য মানুষেরা কি আমায় চেনে? অথবা অন্য কাউকে? আমি আর কিছুই ভাবতে পারছি না। ধীরে ধীরে আমার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। আমি আয়নার সমস্ত কাচ জুড়ে মিশমিশে কালো একটা প্রলেপ দেখতে পাচ্ছি। মুহূর্তে আমি আমার আঙুল দিয়ে সেই কাচের উপর আঁকিবুঁিক করতে লাগলাম। ছোটবেলা এমন কতো করেছি। ভেজা কাঁচের ওপর আঙুল ঘুরিয়ে নাম লিখে নিজের কাছে বীরত্ব প্রমাণের চেষ্টা। কখনো কখনো হয়তো কচি হাতের সেই আলুথালু রেখা তেমন কিছুই হয়ে ওঠেনি। তখন নিজের মনেই কল্পনার ক্যানভাসে দেখে নিয়েছি কোন ঘাসফড়িঙের ছবি কিংবা অন্য কোন পাখির ছবি। অথবা চাঁদের মাঝখানে বসে চাঁদের বুড়ির চরকায় সুতা কাটার মতো কিছু। অথবা সম্পূর্ণই অন্য রকম কিছু। আকাশে টুকরো টুকরো মেঘ দেখে কতোবারই তো মনে হয়েছে-এঁরা হলো ঈশ্বরের হাত। আচ্ছা, ঈশ্বরের হাত কী অনেক রকমের হয়? রহমতের হাত, বরকতের হাত, সৃষ্টির হাত, ধ্বংসের হাত এবং এমনি আরো অনেক রকমের? ইদানিং ঈশ্বরের কিছু হাত কি নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে। যে সমস্ত হাত দিয়ে তিনি মানুষের পৃথিবীতে বৃষ্টি ঝরান। নিবিড় বৃষ্টি। যে হাত দিয়ে মানুষের মনে প্রশান্তির আলপনা একেঁ দেন এবং মানুষের চোখে ঘুম ঢেলে দেন? হতে পারে। হতে পারে। এমন অনেক কিছুইতো হতে পারে। এমনও হতে পারে ঈশ্বরের এই হাতগুলোর অবস্থান অনেক ওপরের দিকে। খাদে-পড়া মানুষের ক্ষুদ্র দৃষ্টি সেখানে পৌঁছায় না। অথবা ঈশ্বরের সেই হাতগুলো সে খাদ পর্যন্ত পৌঁছায় না। 
এসব চিন্তার মাঝেও আমি আমার হাত চালিয়ে যাচ্ছি। দুই হাতের সবগুলো আঙুল দিয়ে আয়নার ওপর কালো প্রলেপটাতে সজোরে আচঁড় কাটছি খুব দ্রুত এবং প্রায় পাগলের মতো। যেন আমার চেনা-অচেনা এবং পৃথিবীর সকল মানুষের মুখ এর আড়ালে ঢাকা পড়ে আছে। এতোক্ষণে কালো প্রলেপটা আমার ঘরের সবকটা দেয়াল এবং ঘরময় ছড়িয়ে পড়েছে। দরজা, জানালা, দেয়াল, আয়না এসবের আর কোন চিহ্ন নেই। যেন সমস্তটা মিলে  একটা অন্ধকারের আবরণ ছাড়া আর কিছুই না। আমি যেন একটা কালো মলাটের ভেতর আটকা পড়ে গেছিÑ বিকৃত ইতিহাসে ভরা বইয়ের পৃষ্ঠার মতো। চারপাশ থেকে অন্ধকার আমাকে চেপে ধরেছে। অন্ধকারের নিশ্চিদ্র বেষ্টনির ভেতর আমি আমার হাত চালিয়ে যাচ্ছি অত্যন্ত ক্ষিপ্রভাবে। কী আশ্চর্য! এতো  সময় ধরে প্রাণপণ চেষ্টা করে কোথাও একটি আচঁড়ও স্পষ্ট করতে পারছি না। নাকি আমি এসব দেখছি না অথবা ভুল দেখছি? এমন তো হতে পারে আমি ইচ্ছে করে কিছু দেখছি না কিংবা এসবের কিছুই ঘটছে না। অথবা এর সমস্তটা একটা ভ্রম।

পাঠকের মন্তব্য Login Registration