নজরুল চর্চায় নিবেদিত যে প্রতিষ্ঠান

প্রতিনিধি | শিক্ষা

সোমবার ২৭ আগস্ট ২০১৮|১৮:৫৫:০২ মি.



আসিফুর রহমান সাগর: ৭৮ বছর বেঁচেছিলেন। কিন্তু তার মধ্যে ৩৪ বছর অসহনীয় নির্বাক জীবন কাটিয়েছেন। জন্মের পর থেকে মাত্র ৪৪ বছর বয়স পর্যন্ত স্বাভাবিক জীবন কাটিয়েছেন। এর মাঝে সাহিত্য রচনার কাল ছিল মাত্র ২৪ বছর। নজরুল বিশ শতকের প্রথমার্ধের কবি ও শিল্পী। সেই সময়ের এক সৃজনশীল কবির সৃষ্টিকর্ম একুশ শতকে এসে কতটা প্রয়োজনীয়?

আসছে সোমবার জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪২তম মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি নির্বাক হয়েছিলেন ৭৭ বছর আগে, তার মৃত্যুর পরও আমরা পেরিয়ে এসেছি প্রায় ৪৩ বছর। কে এই নজরুল? আর কেনই বা তার এমন দিগন্তবিস্তারি প্রভাব? গবেষকরা বলছেন, সাহিত্য রচনার সময়কালের ব্যাপ্তি যাই হোক না কেন নজরুলের প্রভাব শতাব্দি পেরিয়ে আজো সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। মানবতাবাদী কবি নজরুল একুশ শতকে এসে হয়ে উঠেছেন মনুষ্যত্বের কবি। যখন দেশে দেশে সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ, ধর্মীয় কুসংস্কার বাড়ছে। তখন অসাম্প্রদায়িক ও মানবতার কবি নজরুল চর্চার বিকল্প নেই।

নজরুল এক ভাষণে বলেছিলেন, ‘বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের যুগে আমি জন্মগ্রহণ করেছি, এর অভিযান সেনাদলের তূর্যবাদকের একজন, এই হোক আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়।’ কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নজরুল তূর্যবাদকদের একজন নন তিনি ছিলেন সেই তূর্যবাদক দলের নায়ক। বিশ্ব চেতনার ধারক অন্যতম এক বাঙালি ছিলেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। যিনি তার কবিতা ও গান দিয়ে জাগিয়ে তুলেছিলেন বাঙালিকে। তিনি একাধারে বিদ্রোহী কবি, তিনি প্রেমের কবি, তিনি শোষিতের কবি। নজরুলের বিশ্বাসের গভীরে ছিল ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই নহে কিছু মহীয়ান’ আর সে কারণেই তিনি মানুষের বিভেদ সৃষ্টিকারী দেয়ালগুলো ভাঙতে চেয়েছিলেন।

ভাষাসৈনিক, নজরুল গবেষক এবং নজরুল ইন্সটিটিউটের সভাপতি অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বললেন, কাজী নজরুল ইসলাম শুধু মানবতার কবি নন একুশ শতকে এসে তিনি মনুষত্বের কবি হিসাবে আবির্ভূত হয়েছেন। আমরা যদি মানুষকে মর্যাদা দিতে না পারি তাহলে সেই সভ্যতা মূল্য বহন করে না। নজরুল এই কথাই তার সারাজীবনের সাধনায় বলার চেষ্টা করেছেন। তাই মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ও সভ্যতার অগ্রগতিতে আমাদের জাতীয় কবিকে, তার রচনার চর্চা ও তা আত্মস্থ করে মানবজীবনে তা প্রতিফলনের বিকল্প নেই।

নজরুল বিশেষজ্ঞ রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. বিশ্বজিত্ ঘোষ বললেন, আজ বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মানবতা পর্যুদস্ত, মানুষের সঙ্গে মানুষের বিরোধ প্রবলতর। বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘাত ভয়াবহতর। এ প্রেক্ষাপটে কাজী নজরুল ইসলাম এখন তার কালের চাইতেও আজ অধিক মাত্রায় প্রাসঙ্গিক। নজরুলের এই প্রাসঙ্গিকতা অব্যাহতভাবে বিরাজমান আমাদের সমাজে। মানুষের মুক্তি যতদিন না আসে, যতদিন থাকবে বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের মধ্যে স্বার্থের সংঘাত, ততদিন নজরুল তার সৃষ্টিকর্মে অব্যাহতভাবে থাকবেন প্রাসঙ্গিক।

কবি নজরুল যখন বাংলাদেশে পা রাখেন তখন তিনি কথা বলতে পারেন না। কিন্তু রচনার প্রতি মানুষের যে অতুলনীয় ভালোবাসা, সেই টানেই পুরো দেশের মানুষ তাঁকে বুকে টেনে নিয়েছিলেন। তিনি শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেও তাঁকে ঘিরে ভক্ত শিল্পীদের ভিড় জমে থাকতো। তাঁকে গান শুনিয়ে নিজেকে ধন্য করতেন শিল্পীরা। তার প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা থেকেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কাজী নজরুল ইসলামকে ‘জাতীয় কবি’ হিসেবে স্বীকৃতি দেন। পরবর্তী সময়ে চালু করা হয় কবি নজরুল ইন্সটিটিউট। প্রতিষ্ঠানটি গবেষণার পাশাপাশি নজরুল সঙ্গীত ও কবিতার প্রশিক্ষণও পরিচালনা করে। সারাদেশেই নজরুল সঙ্গীতের চর্চা হচ্ছে। এছা্ড়া ছায়ানট, নজরুল একাডেমির মত বিভিন্ন সংগঠনও নজরুল চর্চা প্রসারে নিয়মিতভাবে কাজ করে চলেছেন। সরকারিভাবে নজরুল ইন্সটিটিউটের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। ময়মনসিংহের ত্রিশালে বটতলায় ৩৫ একর জমির উপর সরকারিভাবে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় নামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। এদিকে কুমিল্লা মহানগরীর ধর্মসাগর উত্তর পাড়ে নজরুল ইন্সটিটিউট, কুমিল্লা তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

কবি নজরুল ইন্সটিটিউটের কার্যক্রম

তিনি নেই কিন্তু তার রচনা আজো মানুষকে আলোড়িত করে। যত দিন যাচ্ছে কবি নজরুল নতুন মাত্রায় উদ্ভাসিত হচ্ছেন আমাদের মাঝে। তাকে নিয়ে গবেষণা ও তার সৃষ্টিকে নতুন প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতে নানা উদ্যোগ চলমান। কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিকে ধরে রাখতে ১৯৮৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ধানমন্ডিতে কবির বাসভবনেই প্রতিষ্ঠা করা হয় নজরুল ইন্সটিটিউট। প্রধানত নজরুলকে নিয়ে গবেষণা ও তাঁর সৃষ্টিকে পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতেই এ উদ্যোগ নেয় সরকার।  তখন থেকেই প্রতিষ্ঠানটি কবির রচনা নিয়ে গবেষণা, কবির সঙ্গীতসহ সকল রচনা সংগ্রহ, সংরক্ষণ, সম্পাদনা ও প্রকাশ, তাঁর সামগ্রিক অবদান সম্পর্কে আলোচনা-সভা, বক্তৃতামালা, সেমিনার, সম্মেলনের আয়োজন, কবির জীবন ও কর্ম সম্পর্কে বইপত্র, গানের রেকর্ড, টেপ, ছবি, ফিল্ম ইত্যাদি নিয়ে গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা, তাঁর গানের বিকৃতিরোধে স্বরলিপি প্রণয়ন, গ্রামোফোন রেকর্ড, টেপরেকর্ড ও ছায়াছবি নির্মাণ, কবিতা আবৃত্তি ও  সঙ্গীত বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া এবং কবিকে নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে অবদানের জন্য লেখকদের পুরস্কার দেয়া।

কবি নজরুল ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক মোঃ আব্দুর রাজ্জাক ভূঞা বললেন, গবেষণা গ্রন্থ, স্মারকগ্রন্থ, বাংলা ও ইংরেজি পত্রিকা, নজরুলের রচনার নতুন সংস্করণ, শাখাভিত্তিক বিভিন্ন সংকলন, গানের স্বরলিপি, অ্যালবাম, নজরুল-রচনার ইংরেজি অনুবাদ ইত্যাদি নিয়ে ইন্সটিটিউটের প্রকাশনার সংখ্যা বিপুল। নজরুল ইন্সটিটিউট গবেষণা ও প্রকাশনার ক্ষেত্রে এরমধ্যেই অনেক কাজ করেছে। এ বছরই তারা প্রকাশ করতে যাচ্ছে ১১ খণ্ডে নজরুল সমগ্র। সেইসঙ্গে এক হাজার ৬০০ আদি গানের রেকর্ডও প্রকাশের কাজ চলছে। এর পাশাপাশি নজরুল ইন্সটিটিউটের আয়োজনে দেশের ৩০টি জেলায় পর্যায়ক্রমে নজরুল সম্মেলনের আয়োজন করা হচ্ছে।

নজরুল ইন্সটিটিউটের প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- স্ত্রী প্রমীলা ও সন্তানসহ নজরুলের ছবি ও নজরুল স্মৃতি সংক্রান্ত ১১০টি চিত্রসহ নজরুল-অ্যালবাম। তবে নজরুল ইন্সটিটিউটের সবচেয়ে বড় কাজ নজরুল সঙ্গীতের শুদ্ধ স্বরলিপি প্রকাশ। এখন পর্যন্ত ৪০ খণ্ডে স্বরলিপি প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠা বছরেই নজরুলের গানের বাণী ও সুরের শুদ্ধতা যাচাই করার জন্য বিশেষজ্ঞ সমন্বয়ে একটি ‘নজরুল সঙ্গীত স্বরলিপি প্রমাণীকরণ পরিষদ’ গঠিত হয়। এ পরিষদ প্রধানত মূল গ্রামোফোন রেকর্ডের বাণী ও সুরের সঙ্গে মিলিয়ে নজরুল সঙ্গীতের প্রমাণীকরণের কাজ করে থাকে। এই শুদ্ধ সঙ্গীতের স্বরলিপি করার ক্ষেত্রে পথিকৃত্ ব্যক্তিত্ব ছিলেন প্রয়াত সুধীন দাশ। এছাড়াও স্বরলিপি করার ক্ষেত্রে আরো যাদের অবদান রয়েছে তারা হলেন আসাদল হক, ব্রহ্মমোহন ঠাকুর, রশিদুন্ নবী, সালাউদ্দিন আহমেদ, এস এম আহসান মুর্শেদ, সেলিনা হোসেন, ইদিরস আলী ও নিখিলরঞ্জন নাথ।

আর নজরুল ইন্সটিটিউটের কাজের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে তাদের গবেষণা গ্রন্থগুলো। এ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি ৪৩টি গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। এছাড়া, ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষায় এ পর্যন্ত ২৬টি গ্রন্থ প্রকাশ করেছে তারা। আদি গ্রামোফোন রেকর্ড থেকে ধারণকৃত নজরুল সঙ্গীতের এ পর্যন্ত ৩১টি অডিও সিডি প্রকাশ করা হয়েছে, শুদ্ধ সুর ও বাণী নিয়ে নজরুল সঙ্গীতের ৩০টি অডিও সিডি প্রকাশ করা হয়েছে। এছাড়াও রয়েছে, আবৃত্তির সিডি ও অডিও ক্যাসেট। এছাড়া, নজরুলের কাব্যগ্রন্থ ও অন্যান্য রচনাবলীও নিয়মিতভাবে প্রকাশ করে আসছে প্রতিষ্ঠানটি।

এসবের পাশাপাশি নজরুল ইন্সটিটিউটের একটি উল্লেখযোগ্য কাজ হচ্ছে সঙ্গীত ও আবৃত্তি শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা। নতুন প্রজন্মের মাঝে শুদ্ধ নজরুল সঙ্গীতের চর্চা বাড়ানোর জন্য এই কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ইন্সটিটিউটের উপ-পরিচালক কবি রেজাউদ্দিন স্ট্যালিন বললেন, এই প্রশিক্ষণ কোর্সটি খুব প্রয়োজনীয়। গবেষণা, কবির রচনা প্রকাশ খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে যদি শিশু বয়স থেকে নজরুলের সঙ্গে পরিচয় ঘটানো না যায় তবে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ধীরে ধীরে মানুষের মন থেকে হারিয়ে যাবে।

নজরুল ইন্সটিটিউট প্রশিক্ষণের জন্য মোট ১৩টি কোর্স পরিচালনা করে। এখন তাদের শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিনশ’। এ বছর আবার নতুন করে দেড়শ’ শিক্ষার্থী ভর্তি হবে। খুব কম খরচে সঙ্গীত শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে প্রতিষ্ঠানটি। আর প্রশিক্ষক হিসেবে রয়েছেন- শিল্পী খালিদ হোসেন, সেলিনা হোসেন, রওশন আরা ইসলাম সোমা, ড. লীনা তাপসী খান, শামসুন্নাহার চৌধুরী, ছন্দা চক্রবর্তী, ফেরদৌস আরা, মো. ইদিরস আলী, সালাহউদ্দিন আহমেদ, ইয়াকুব আলী খান, মো. শহীদুল ইসলাম খান প্রমুখ। আর আবৃত্তি প্রশিক্ষক হিসেবে রয়েছেন নিরঞ্জন অধিকারী, লায়লা আফরোজ প্রমুখ।

প্রকাশনা ও প্রশিক্ষণ ভালোভাবে চললেও অযত্নে অবহেলায় পড়ে রয়েছে নজরুল জাদুঘরটি। নজরুলকে তুলে ধরতে খুব ভালো আয়োজন নেই সেখানে। কিছু ফটোগ্রাফ ও রচনার ফটোকপি ছাড়া উল্লেখযোগ্য খুব একটা কিছু নেই সেখানে। নজরুল ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক মো. আব্দুর রাজ্জাক ভূঞা বললেন, ‘ঢাকাস্থ নজরুল ইন্সটিটিউটের নতুন ভবন নির্মাণ এবং ঢাকা, ময়মনসিংহ ও কুমিল্লায় বিদ্যমান ভবনের রিনোভেশন’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন ভবন নির্মাণ ও অন্যান্য কাজ করা হবে। নতুন ভবন হওয়ার পর জাদুঘরটিকে ঢেলে সাজানো হবে।সূত্র- ইত্তেফাক

পাঠকের মন্তব্য Login Registration