জাহাঙ্গীরনগর ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে সংস্কৃতির মিলনমেলা

প্রতিনিধি | শিক্ষা

শুক্রবার ১৮ জানুয়ারী ২০১৯|১৬:৩৭:৩৮ মি.



মাহমুদুল হক

ওহকি গাড়িয়াল ভাই, হাকাও গাড়ি তুঁই চিলমারীর বন্দরে রে…। মনোমুগ্ধকর গানের সুর ভেসে আসছে একটি কক্ষ থেকে। একটু উঁকি দিয়েই দেখা গেল এহেন দৃশ্য শুধু ঐ কক্ষেরই নয়, গানের কক্ষের পাশেই একটি ছোট জটলা থেকে ভেসে আসছে তা তা থৈ থৈ, তার সঙ্গে নৃত্যের তালে ঝুমুরের শব্দ। অপর পাশের একটি কক্ষ হতে শোনা যাচ্ছে যেন নজরুলের বজ্র কণ্ঠের আওয়াজ ‘বল বীর বল মম উন্নত করি শির…’।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপার লীলাভূমি সংস্কৃতির রাজধানীখ্যাত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি) এমন দৃশ্য চোখে পড়লো। পড়ন্ত বিকেল থেকে গোধুলী পর্যন্ত এহেন দৃশ্য শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতেই দেখা যায়। এ যেন সংস্কৃতির আঁখড়াখানা, সংস্কৃতির মিলনমেলা!

সরেজমিনে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় টিএসসি ভবনে বিভিন্ন সংগঠনের জন্য মোট ১০টি অনুশীলন কক্ষ রয়েছে। ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের তালিকাভূক্ত সংগঠন আছে প্রায় দেড় শতাধিক। মোট ১০টি সংগঠন নিয়ে সাংস্কৃতিক জোট পরিচালিত হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংগঠনগুলো হল: কাল বৈশাখী, সুস্বর, আনন্দন, জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটার, ধ্বনি, জলসিড়ি, রিদম, গীতনাট্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ডিবেট অর্গানাইজেশন(জুডো) ইত্যাদি। প্রত্যেটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের অবস্থানই টিএসসিতে।

ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকদের মাঝে সম্পর্ক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। আরও ভূমিকা রাখছে দেশের সংস্কৃতিকে ধারণ করে ও লালন করে। এই কেন্দ্রটিকে ঘিরেই এখানের সাংস্কৃতিক আসর। সংস্কৃতির রাজধানী খ্যাত জাবিকে অনেকেই আদর করে ‘জানবিবি’ বলে ডেকে থাকেন। যার পরতে পরতে রয়েছে নাচ, গান, কবিতা, নাটক আরও কত কিছু…! সারাদিনের ক্লাস পরীক্ষা শেষে বিকেলে পরিশ্রান্ত মন নিয়ে শিক্ষার্থীরা ছুটে আসে এখানে একটু প্রশান্তি পেতে। এই সংগঠনগুলো যেন তাদের প্রাণের প্রয়াস; যা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মাঝে এনে দেয় এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশের ছোঁয়া।

সংগঠনগুলোর মধ্যে অন্যতম হল সুস্বর। সংগঠনটি ২০১৪ সালে ‘শুদ্ধ গানের প্রসারে’ এই স্লোগানকে ধারণ করে যাত্রা শুরু করে। ২০১৬ সালের ১৪ নভেম্বর টিএসসির ১০নং কক্ষে যাত্রা শুরু করে সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘রিদম’। সংগঠনটি পরিচালনার দায়িত্বে আছেন সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষার্থী নবীউল ইসলাম বাপ্পী।

বাপ্পী বলেন, সংগঠনটি মাটি-গান, নৃত্য, আবৃত্তি, চিত্রকলা প্রদর্শনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ধারা তুলে ধরার পাশাপাশি নতুন মাত্রা যোগ করার উদ্দেশ্যে কাজ করে। যেন তরুণ প্রজন্ম তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে বুকে ধারণ করে।

‘আনন্দন’ একটি স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক সংগঠন। ‘বিকশিত মেধায় লড়ব একুশ শতক’ স্লোগানকে ধারণ করে সংগঠনটি যাত্রা শুরু করে। রবীন্দ্র নজরুল ফোক ইত্যাদি গানে সংগঠনের কর্মীরা মোহিত করে রাখে মুক্তমঞ্চের হাজারো দর্শক।

এতো গেল গান, এবার নাচের দিকে ফেরা যাক। নাচের কথা বলতেই প্রথমে আসে কালবৈশাখী ও গীতনাট্য এর কথা। কাল বৈশাখী! নামটি শুনলেই কেমন যেন মনের ভেতর এক ঝড়ো হাওয়া বয়ে যায়। হ্যা, ঠিক তাই কাল বৈশাখীর পরিবেশনা অনেকটা ঝটিকা মিছিলের মতোই। এর পরিবেশনা দেখলেই মনে পড়ে যায় কবি গুরুর সেই উক্তিটি ‘সব কথা গেল কয়ে কোন কথা না কয়ে’।

গান আর নাচ না হয় হলো। তাই বলে একটু কবিতার স্বাদ পাব না তা তো আর হবে না। তাহলে আর দেরি কেন? চলে আসুন ধ্বনির কাছে। মনে হয় যেন শব্দ আর বাক্য নিয়ে খেলা করে সে। কি তার তেজ! বজ্রের মতো তার কণ্ঠ। মুহূর্তেই বিমোহিত করে দর্শকদেরকে।

এত কিছুর মাঝেও নিজেকে যদি একটু যুক্তিবাদী মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চান তাহলে চলে আসুন জাহাঙ্গীরনগর ডিবেট অর্গানাইজেশন (জুডো) তে। ২০০৫ সালের ২৩ ডিসেম্বর ‘লেট বি লাইটেনড’ স্লোগানকে সামনে রেখে সংগঠনটি যাত্রা শুরু করে। চলমান বিশ্বের নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা সমালোচনা করে ইতোমধ্যেই সুনাম কুড়িয়েছে দেশ বিদেশে। সংগঠনের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক মুসফিক উল সালেহীন বলেন, যুক্তিতে যুদ্ধ জয়ই তাদের মূল লক্ষ।

আর নাটক কথাটি স্মরণ করতেই মনে পড়ে যায় নাট্যাচার্য ও নাট্যগুরু সেলিম আল দীনের কথা। তার হাতের ছোঁয়াতেই বিখ্যাত হয়ে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্য সংগঠন জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটার। তিন যুগ ধরে এই সংগঠনটি তাদের পরিবেশনা দিয়ে মুগ্ধ করে রেখেছে সারা দেশের মানুষকে। সেই সাথে দেশের সংস্কৃতিকে আরেক ধাপ তুলে ধরতে কাজ করছে নিরলস ভাবে।

তবে যে সংগঠন গুলোর কথা বলা হল তাদের মূল চালিকা শক্তি ও প্রাণবায়ু হলো শিক্ষার্থীরা। তাদের পদচারণা ও ঘামের ফসলই হলো বিশ্ববিদ্যালয় টিএসসির সংস্কৃতি।

বিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক জোটের বর্তমান সভাপতি আশিকুর রহমান আশিক বলেন, বিভিন্ন উপলক্ষে সংগঠনগুলো ভিন্ন ভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। বিশেষত পহেলা ফাল্গুন, বিশ্ববিদ্যালয় দিবস ও সংগঠনগুলোর বর্ষপূতিতে। তবে পর্যাপ্ত বাজেট না থাকায় এবং সাংস্কৃতিক কর্মীদের উপর বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হামলার কারণে মাঝে মাঝে কাজ করতে সমস্যা হয়। তবে ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটছে।

বিকেল হলেই টিএসসিতে ঘুরে আসতে পারেন। কোথাও বা বাজছে বাশের বাঁশি, কোথাও পায়ের ঘুঙ্গর বেঁধে নৃত্যর ঝংকার, আবার কোথাও প্রতিবাদী দীপ্ত কণ্ঠস্বর, তবে মন ভুলানো অভিনয় থেকেও বঞ্চিত হবেন না কেউ। সংস্কৃতির সকল প্রবাহ ধারা যেন একসাথে খেলা করছে এই আঙ্গিনায়। যেন এক অপরূপ সংস্কৃতির সংমিশ্রণ। নাচ, গান, কবিতা, নাটক, বিতর্ক সব মিলিয়ে এ যেন এক নতুন ভূবন!

শিক্ষকদের নির্দেশনার মাধ্যমে এই সংগঠনগুলো চলার শক্তি পায়। আমরা আমাদের সংস্কৃতিকে লালন করি, ধারণ করি নিজের হৃদয়ে। হয়তো কখনো কখনো কোন ছলনায় ভুলে থাকার প্রয়াস চলে আসে নিজের মনে। আর ঠিক তখনই নিজের অস্তিত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে ভুল করে না এই সংগঠনগুলা। আর তার পরিপূর্ণ রুপ দেয় প্রিয় জানবিবির টিএসসি। এ যেন সংস্কৃতির মিলন মেলা, যেথায় আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ ও ঐক্যমত্য।

পাঠকের মন্তব্য Login Registration