ঐতিহ্যের লাঠি এখন রুপন্তীর হাতে

প্রতিনিধি | শিল্পকলা

শনিবার ৫ জানুয়ারী ২০১৯|১৫:৩৮:৩৬ মি.



ইমাম মেহেদী : এক হাতে লাঠি, অন্য হাতে ঢাল। হাতে লাঠির বদলে কখনো লম্বা তলোয়ার। ডাগর চোখে সামনে আসলে মায়া বন বিহারিণী। লাঠিখেলার মাঠে সে বাঘিনী। ঘরে লাজুক, মিষ্টি মেয়ে। খেলার মাঠে চোখ মুখের গর্জনে জয়ের ধ্বনি। হাতের লাঠিতে তার বিরল জাদু। এ যেন সাপুড়ের বাঁশি। মাঠে নামলেই চারদিকে দর্শকের করতালি। বলছিলাম রুপন্তীর কথা। পুরো নাম মঞ্জুরীন সাবরিন চৌধুরী রুপন্তী। জš§ ৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৪ সালে কুষ্টিয়া শহরের মজমপুর। দুই বোনের মধ্যে রুপন্তী বড়। কুষ্টিয়া সরকারি বালিকা বিদ্যালয় থেকে ২০১০ সালে এসএসসি পাস করে চলে আসেন ঢাকায়। রুপপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে বর্তমানে রাজধানীর ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটিতে পড়ছেন ম্যানেজম্যান্ট বিষয়ে।
রুপন্তীর সঙ্গে তিন পুরুষের ঐতিহ্যের লাঠিখেলা নিয়ে কথা হলো গত ৪ আগস্ট, ২০১৮ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঢাকার মিরপুর সাড়ে এগারো নম্বরের বাসায়। রুপন্তী জানালেন, লাঠিখেলা তাদের শত বছরের পারিবারিক ঐতিহ্য। এর সঙ্গে মিশে রয়েছে তিন প্রজন্মের প্রায় শত লাঠি খেলোয়াড়ের স্মৃতি। নারী-পুরুষ, ছেলে-মেয়ে বিভেদ নাই। পরিবারের কমবেশি সবাই পারদর্শী। দাদা সিরাজুল হক চৌধুরী যাকে সবাই চেনেন ওস্তাদ ভাই নামে। দাদাই ১৯৩৩ সালে প্রথম নিখিল বঙ্গ লাঠিয়াল বাহিনী প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে দাদার হাত ধরেই বাবা মঞ্জরুল হক চৌধুরীর (রতন চৌধুরী) হাতে লাঠি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর নাম পরিবর্তন করে রাখেন বাংলাদেশ লাঠিয়াল বাহিনী। আর আমি তো এখন নিয়মিত লাঠিখেলা করি।
শতবছরের তিন পুরুষের ঐতিহ্যের লাঠি এখন রুপন্তীর হাতে। তবে শুরুটা ছোট বেলায় ওস্তাদ শুকুর আলী ও ওসমান সরদারের হাত থেকেই। ওসমান সরদারই রুপন্তীর লাঠিখেলার গুরু। তিনি পদ্মার চর খেলায় বিশেষজ্ঞ ছিলেন। রুপন্তীর পরিবারের সবাই লাঠিখেলায় জড়িত। ফুফু হাসনা বানু বাংলাদেশের প্রথম নারী লাঠিয়াল। ফুফাতো বোন শাহিনা সুলতানা ও শারমিন সুলতানাও লাঠিখেলায় পারদর্শী। অষ্টম শ্রেণীতে পড়া ছোটবোন ক্রমন্তির হাতেও লাঠিখেলা করে।
কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ছাড়াও নড়াইলের সুলতান উৎসবে তিনবার তিনি লাঠিখেলায় অংশ নিয়েছেন। ২০১৮ সালের ২১ জানুয়ারিতে দর্শকের মন জয় করেছেন যশোরের মধুমেলাতেও। ১৪২২ এবং ১৪২৩ খ্রিস্টাব্দে পহেলা বৈশাখে ঢাকার টিএসসিতে, ২০১৭ মাচের্র ৪ তারিখে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারেও লাঠিখেলায় অংশগ্রহণ করে দারুণ নৈপুণ্য দেখিয়েছেন। গতবছর প্রথম আলো আয়োজিত ছায়ানটে সাত মার্চ নারী দিবস উপলক্ষে পেয়েছেন সম্মাননা ২০১৭।
সফল কৃতী শিক্ষার্থী হিসেবে কুষ্টিয়া সরকারি বালিকা বিদ্যালয় থেকে সদর আসনের এমপি মাহবুবু উল আলম হানিফের হাত থেকে পেয়েছেন সম্মাননা স্মারক ২০১৮। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে রুপন্তী ও তার লাঠিয়াল বাহিনীর সংবাদ। বর্তমানে তিনি দাদা ভাই রোকুনুজ্জামানের কচি-কাঁচার মেলায় প্রশিক্ষক হিসেবে শিশুদের লাঠিখেলা শেখান। দায়িত্ব পালন করছেন বাংলাদেশ লাঠিয়াল বাহিনীর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে। বর্তমানে বাংলাদেশ লাঠিয়াল বাহিনীর নিবন্ধিত সদস্য সংখ্যা প্রায় ৫ হাজারের মতো।
লাঠিখেলার বিষয়ে রুপন্তী বললেন, এটা আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্যের তিন পুরুষের খেলা। মেয়ে হয়ে জš§ নিয়েও যে স্বাধীনভাবে সংস্কৃতি চর্চা ও খেলাধুলা করা যায় আমাদের পরিবারই তার উদাহরণ। লাঠিখেলা শুধু ঐতিহ্য নয়, আত্মরক্ষার জন্য প্রয়োজন। বিশেষ করে মেয়েদের জন্য। কারণ পথে ঘাটে চলতে বিভিন্ন সময় মেয়েদের ইভটিজিংয়ের শিকার হতে হয়। খেলাধুলা করলে মন ও শরীর দুটোই ভালো থাকে। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে লাঠিখেলা বিলুপ্তির পথে। কারণ এখানে লাঠিয়ালরা সরকারি-বেসরকারিভাবে কোনো অর্থ পান না।
লাঠিখেলা যেহেতু আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির অংশ, সেহেতু আমরা চাই এটি ধরে রাখতে। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে এটাকে যদি জাতীয়ভাবে আয়োজন করা যায় তাহলে আরো উন্নয়ন করা সম্ভব। আমি তো এখন প্রায় সারা বাংলাদেশেই লাঠিখেলা করছি। আমি চাই জাতীয় থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমাদের লাঠিয়ালদের নৈপুণ্য তুলে ধরতে।
পাশ থেকে রুপন্তীর জীবনসঙ্গী রাজধানীর সিটি ইউনিভার্সিটির মানবসম্পদ উন্নয়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাব্বির হাসান চৌধুরী মজা করে বললেন, বউয়ের কারণেই সবাই আমাকে চেনে।
রুপন্তী পাল্টা উত্তরে বললেন, সাব্বিরও দারুণ লাঠিয়াল, আমাকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করে এবং উৎসাহ দেয়। রুপন্তীর মা মোশরেবা খাতুন জানালেন, আমাদের কোনো ছেলে সন্তান নেই। লাঠিখেলা এখন আমাদের পরিবারেরই একটি অংশ। মেয়েদেরকে নিয়ে আমি গর্ব করি। 
সূত্র: মানবকন্ঠ

পাঠকের মন্তব্য Login Registration