হারিয়ে যাচ্ছে আবহমান গ্রাম বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য ঘানি

প্রতিনিধি | শিল্পকলা

শনিবার ২৪ নভেম্বর ২০১৮|১০:১৫:২১ মি.



মহাদেবপুর নওগাঁ থেকে ইউসুফ আলী সুমন,

আধুনিক বিজ্ঞানের জয়যাত্রার যুগে নিত্যনতুন যন্ত্রপাতি আবিষ্কারের ফলে মানুষের প্রতিটি কাজ হচ্ছে সহজ থেকে সহজতর। বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে উন্নত প্রযুক্তি ও যন্ত্রচালিত শক্তি ব্যবহারে স্বল্প খরচ ও স্বল্প সময়ে অধিক কাজ সমাধান করা ও উৎপাদন বৃদ্ধির প্রবণতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। যন্ত্রচালিত শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় গ্রাম বাংলার অনেক প্রাচীন ঐতিহ্যই আজ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।

এমনি একটি বিলুপ্ত প্রায় তেলের ঘানি। খুলু সম্প্রদায় আজ আর তেমন নেই। ঘানিতে তেল উৎপাদনকারীকে স্থানীয় ভাবে খুলু ও সাজি বলা হয়ে থাকে। সময়ের বিবর্তন ও জীবন-জীবিকার তাগিদে তারা পেশা বদল করেছে। তাই চোখে পড়ে না খুলুর ঘানিও। এক সময় নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার প্রায় গ্রামেই খুলু সম্প্রদায়ের লোকজন বসবাস করতো। তাদের পেশাই ছিল সরিষা থেকে তেল উৎপাদন করা এবং গ্রামে গ্রামে ফেরি করে তা বিক্রি করা। ঘানি দিয়ে তেল উৎপাদনে ব্যয় বৃদ্ধি এবং প্রত্যন্ত এলাকাতেও তেলকলের প্রচলন হওয়ায় কমে যাচ্ছে খুলুদের কদর।

আধুনিক মেশিনে উৎপাদিত সরিষার তেলে এখন বাজার সয়লাব। তাই শত শত খুলু পরিবার তাদের ঘানি বন্ধ করে এখন মানবেতর জীবন যাপন করছে। মহাদেবপুর উপজেলায় একসময় ছয়-সাত শতাধিক খুলু পরিবার বাস করত।এসব পরিবারের লোকজন স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সরিষা কিনে বাড়িতে ঘানি টেনে তৈরি করত খাঁটি সরিষার তেল। সময়ের সাথে সাথে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে এখন আর গরুর ঘানি খুঁজে পাওয়া অত্যন্ত দুস্কর।

উপজেলার চেরাগপুর ইউনিয়নের চেরাগপুর (সাজিপাড়া) এক সময় এ পাড়ার প্রতিটি ঘরেই ছিল তেলের ঘানি। যার কারণে এ পাড়ার নামকরন হয়েছিল সাজিপাড়া। পৈত্রিক ব্যবসা হিসেবে এই শিল্পকে এখনও টিকিয়ে রেখেছেন এ পাড়ার বাসিন্দা মন্টু সাজি। তার সঙ্গে কথা বলে ঘানি শিল্প সম্পর্কে জানা যায় অনেক কথা। 

বৈদ্যুতিক মেশিনে তেল উৎপাদন এবং গরুর ঘানির মাধ্যমে তেল উৎপাদন প্রক্রিয়া একটু ভিন্ন। এক্ষেত্রে একটি গোলাকার কাঠের গুঁড়ি লম্বাভাবে সরাসরি ঘানিতে পোঁতা থাকে যাকে গাছ বলা হয়। মাটি থেকে এর দৈর্ঘ্য থাকে ৪ ফুট এবং ব্যাস দেড়ফুট। মাটি থেকে প্রায় ২ ফুট উচ্চতায় একটি বিশেষ আকৃতির ছিদ্রের ভেতর দিয়ে ‘পাতারী’ নামক টিনের পাতের গা বেয়ে তেল ড্রামে সংরক্ষিত হয়।

গাছের উপরাংশে “ওরা” নামক একটু উচ্চতা এবং দেড় ফুট ব্যাসের একটি ফাঁকা কাঠের গুঁড়ি সংযুক্ত থাকে যার মাঝে সরিষা ঢেলে দেয়া হয়। “ওরা”র মাঝখানে বসানো থাকে “জাইট” নামক ৪ ইঞ্চি ব্যাসের এবং ৩ ফুট দৈর্ঘ্যরে একটি কাঠের শক্ত দন্ড যা অনবরত ঘুরে ঘুরে সরিষা ভাঙ্গাতে সাহায্য করে। “জাইট” এর নিম্নাংশে বাঁশের তৈরি জোয়ালের মাধ্যমে গরুর কাঁধের সঙ্গে যুক্ত করা হয়।

জাইটের উপরাংশে যুক্ত খাতে “ডেকা” নামক আরও একটি কাঠখু। গাছের মাঝ অংশে একটুকরা গলই কাঠ যুক্ত থাকে যার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয় “কাতনি” নামক প্রায় ৭-৮ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১ ফুট প্রস্থের আরও একটি কাঠ। কাতলির প্রথমাংশে “মথন” নামক একটুকরা কাঠ যুক্ত থাকে ‘জাইটের অগ্রভাগে সংযুক্ত “ডেকা” এবং বাতানির সঙ্গে যুক্ত “মথন” একটি শক্ত ও মোটা রশির মাধ্যমে টানা দেয়া হয়। কাতানির শেষ প্রান্তে বেশ ওজনের কাঠের গুঁড়ি দেয়া থাকে। তিনি আরো জানান, পূর্বের মত এখন গরুর ঘানির মাধ্যমে তৈল উৎপাদন একমাত্র পদ্ধতি হিসেবে বহাল না থাকলেও এখনও ঘানি তেলের চাহিদা রয়েছে বলেই এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছে।

এ শিল্প টিকে থাকার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে এতে লোহার ব্যবহার নেই বললেই চলে। কাঠের সঙ্গে কাঠের ঘর্ষণের ফলে এবং সম্পূর্ণ অবৈদ্যুতিকভাবে ঘানিতে তেল উৎপাদন করা হয় বলে গ্রামের লোকজন খাঁটি সরিষার তেল বলতে গরুর ঘানির তেলকেই মনে করে থাকে। বিভিন্ন প্রকার ভর্তা, আচার তৈরিসহ বিভিন্ন প্রকারের রান্না করতে এখনও গ্রামের লোকজন খাঁটি সরিষার তেল হিসেবে ঘানির তেল ব্যবহার করে। নবজাতকের শরীরে অত্যাধুনিক বিভিন্ন প্রকার বেবী লোশনের পরিবর্তে খাঁটি সরিষার তেল মালিশ করার প্রচলন কেবল গ্রামাঞ্চলেই সীমাবদ্ধ নয়, শহরের অনেক পরিবারে এখনও এই প্রচলন দেখা যায়।

আর তাই বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ আজও ঘানির খাঁটি সরিষার তেল সংগ্রহের জন্যে ছুটে আসেন। এ শিল্প বিলুপ্তির কারণ হিসাবে তিনি বলেন, একটা সময় ছিল যখন গ্রামে গ্রামে ঘানি দেখতে পাওয়া যেত। ঘানিই ছিল সরিষা থেকে তেল উৎপাদনের একমাত্র মাধ্যম। ঘানি শিল্প বিলুপ্তির পথে যাবার প্রধান কারণ হচ্ছে এতে সময় ও খরচ অনেক বেশি হয়। রাত ২টা/৩টা থেকে ঘানি চালু করে সন্ধ্যা ৭টা/৮টা পর্যন্ত একটানা চালানোর পরও ১মণ সরিষা ভাঙানো সম্ভব হয় না। খুব বেশি হলে ৩৫ কেজি পর্যন্ত ভাঙ্গানো সম্ভব হয়।

অপরদিকে মেশিনে ভাঙ্গালে মণ প্রতি সময় লাগে মাত্র ২ঘণ্টা। কোন কৃষক বা পাইকারী তেল বিক্রেতা ঘানিতে সরিষা ভাঙ্গালে প্রতি ৫ কেজিতে দাম নেয়া হয় ১শ ৫০ টাকা অপর দিকে বৈদ্যুতিক মেশিনে ভাঙ্গালে দাম নেয়া হয় মাত্র ১শ টাকা। ঘানির তৈল বিক্রি হয় প্রতি কেজি ১শ ৫০ টাকা অপরদিকে মেশিনে ভাঙ্গানো তেল বিক্রি হয় প্রতি কেজি ১শ ১০ টাকা দরে। দামের ব্যাপক তফাতের প্রশ্নে তিনি জানান, ঘানিতে একাধিক গরুর অবশ্যই প্রয়োজন আবার প্রতিটি গরুর খাদ্য বাবদ দৈনিক খরচ ও শ্রকিকের মজুরি দিতে হয়।

তাছাড়া ১৪ ঘণ্টায় পরিশ্রমের পর সরিষা ভাঙ্গানো যায় মাত্র ৩৫ কেজি। তাই দামটা একটু বেশিই পড়ে যায়। তারপরও খরচ বাদ দিয়ে খুব বেশি লাভ থাকে না। মেশিনে অল্প সময়ে বেশি তেল উৎপাদিত হওয়ায় এবং এতে তেলের দাম কমে যাওয়ায় ঘানির তেলের চাহিদা কমে যাচ্ছে। ফলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না খুলুরা। সবকটি ঘানি ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে।

খুলুরা এখন পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছে। এপাড়ায় একমাত্র আমিই কোন রকম বাপ-দাদার পেশাকে আকরে ধরে আছি। তিনি সবশেষে বলেন, লাভ অল্প হলেও মানুষকে এখনও গরুর ঘানির দেশী খাঁটি সরিষার তেল দিতে পারছি এবং নিজেরাও খাঁটি তেল ব্যবহার করতে পারছি এতেই আমার তৃপ্তি।

পাঠকের মন্তব্য Login Registration