নাসিম আহমেদ আবৃত্তি শিল্পের বরপুত্র

প্রতিনিধি | সাহিত্য

রবিবার ২৭ অক্টোবর ২০১৯|১৬:৫৫:৪০ মি.


সৈয়দ আল জাবের 

বাচিক শিল্প বিকাশের কর্মতৎপরতায় যে নামটি সূর্যের মতো দীপ্তিময়, পূর্ণিমা চাঁদের আলোক প্রভায় হয় উল্লোলিত তড়িৎ গতিতে মনে আসে যে নাম তিনি হলেন বরেণ্য ও নন্দিত আবৃত্তিশিল্পী নাসিম আহমেদ। যাকে ‘সোনালী কাবিনে’র কবি আল মাহমুদ ভালোবেসে নাদশিল্পের উচ্চারণশিল্পী অভিধায় অভিষিক্ত করে ডাকতেন। তার কণ্ঠে উচ্চারিত, আবৃত্তিকৃত প্রতিটি কবিতা নতুন প্রাণ লাভ করে নান্দনিক সুষমায়। তার কোমল-গম্ভীর ও ভরাট কণ্ঠের জাদুতে মুগ্ধ হয় শ্রোতাবৃন্দ। মিষ্টভাষী, সদালাপী নাসিম আহমেদ অন্যদের মতো কেবল আবৃত্তিশিল্পী হিসেবে নিজেকে তৈরি করেননি। তিনি আবৃত্তি শিল্পকে কণ্ঠে, মননে ধারণ করার পাশাপাশি কলমেও ধারণ করেছেন বিপুলভাবে যা তার মতো করে আর কেউ করেননি। অথচ এর প্রয়োজনীয়তা ছিল অপরিসীম। এখন যারা আবৃত্তি চর্চা করছেন তাদেরকে ঘুরে ফিরে তারই বইয়ের, লেখনীর শরণ নিতে হয়। আবৃত্তি তথা বাচিক শিল্পের এমনই অপরিহার্য, অনিবার্য, ভাস্বর এক ব্যক্তিত্ব নাসিম আহমেদ। আবৃত্তি শিল্পের এই বটবৃক্ষ হেমন্তের এক প্রহরে পৃথিবীতে পা রাখেন। ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেলার আটিগাঁও গ্রামের মৃত্তিকায়। তারিখটি ছিল ১৯৫৮ সালের একুশে অক্টোবর। তার গর্বিত পিতা দেওয়ান আবদুল আজিজ আহমেদ এবং মাতা রাজিয়া বেগম। তিন ভাই আর চার বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থাকায় দেওয়ান বংশের এ পরিবারটি পুরোপুরি নিঃস্ব হয়ে যায়। পুড়িয়ে দেয়া হয় তাদের বাড়িসহ বিভিন্ন সম্পদ। আবৃত্তি শিল্পের প্রতিভূ পুরুষ নাসিম আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন এবং পেশাগত জীবনে একজন আইনজীবী। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আবৃত্তি শিল্পের নতুন সফর শুরু হয় বিশেষ করে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে। এবং একই সাথে একাডেমিক চর্চার দিকটিও উন্মোচিত হয়। আশির দশকের আবৃত্তি শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ এ অগ্রযাত্রার অগ্রপথিক নাসিম আহমেদ -এর সাথে নিবিড় ও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হন। এ সময়ে আয়োজিত আবৃত্তির বিভিন্ন মঞ্চে বীরদর্পে দাপিয়ে বেড়ান, দর্শকদের বিমোহিত করেন নাসিম আহমেদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবৃত্তি আন্দোলনের অন্যতম সেরা সংগঠক ছিলেন তিনি। আবৃত্তি সংগঠক হিসেবে সমাদৃত হন সর্বমহলে। নানাভাবে যুক্ত ছিলেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় সাংস্কৃতিক দল, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, জাতীয় কবিতা পরিষদ, সমস্বর আবৃত্তি সংসদ, বাংলাদেশ আবৃত্তিশিল্পী সংসদ, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক কর্মী সঙ্ঘ প্রভৃতির সাথে। এ ছাড়াও কাজ করেছেন ঢাকা পদাতিক নাট্যগোষ্ঠী ও বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সাথে। আবৃত্তি চর্চার এরকম সামগ্রিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে যুক্ত রেখে একটি বিষয়ের বেশ অভাব অনুভব করেন আবৃত্তি শিল্পের এ পুরোধা ব্যক্তিত্ব। লক্ষ্য করেন আবৃত্তি শিল্পের ওপর লিখিত তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো সাহিত্য নেই যার মাধ্যমে কেউ এর পাঠ নিতে পারে, এ বিষয়ে জানতে পারে এবং শিখতে পারে। এই শূন্যতা পূরণে এগিয়ে আসেন নাসিম আহমেদ। রচনা করেন আবৃত্তি শিল্পের অসামান্য গ্রন্থ ‘আবৃত্তি প্রসঙ্গ অনুষঙ্গ’। বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৯২ সালে। এটিই আবৃত্তির ওপর বাংলাভাষায় লিখিত প্রথম পূর্ণাঙ্গ বই। এ গ্রন্থটি আবৃত্তি শিল্পের আবশ্যিক পাঠ্যের মর্যাদায় ভূষিত ও বিবেচিত হয়ে আসছে এখনো। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের সিলেবাসভুক্ত করা হয় এ বই। এরপর থেকে একের পর এক তার কলম দিয়ে বেরিয়ে আসে আবৃত্তি শিল্পের ওপর লিখিত বেশ কয়েকটি অনবদ্য বই। যেমন ‘আবৃত্তি পরিচয়’ এ বইটি বাংলাদেশ শিশু একাডেমির আবৃত্তি কোর্সের সিলেবাসভুক্ত এবং তিনিই বাংলাদেশ শিশু একাডেমির আবৃত্তি বিভাগ চালু করেন ও এর সিলেবাসও প্রণয়ন করেন। ‘আবৃত্তি জানবো শিখবো’ তার আরেকটি অসাধারণ কীর্তি। এ বইটিও রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের প্রথম বর্ষের পাঠ্য। এ ছাড়াও লেখেন ‘আবৃত্তি চিন্তা’, ‘আবৃত্তি শেখার নিময় কানুন’, ‘আবৃত্তি প্রকরণ’ বইগুলো। তিনি আবৃত্তি উপযোগী কবিতার দু’টি বইও সঙ্কলন ও সম্পাদনা করেন। বই দু’টি হলো-‘শিশু-কিশোর আবৃত্তি সংগ্রহ’ ও ‘বাংলাদেশের আবৃত্তির কবিতা’। এভাবে নাসিম আহমেদ আবৃত্তি শিল্পের মৌলিক সাহিত্য রচনা করেন এবং গড়ে তোলেন বিরাট জগৎ। ফলে গতিশীল হয় আবৃত্তি শিল্প। উপকৃত হন আবৃত্তিপ্রেমী ও আগ্রহীরা। প্রখর ধী-শক্তিসম্পন্ন ও প্রজ্ঞার অধিকারী এবং জ্ঞানবান মানুষ নাসিম আহমেদ আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার আবৃত্তিরও একজন বিশিষ্ট বিশেষজ্ঞ। এ বিষয়ে তিনি লিখেছেন ‘নজরুল-আবৃত্তি প্রসঙ্গ’ নামে বই, যা নজরুল ইনস্টিটিউট থেকে ২০০১ সালে প্রকাশিত হয়। তিনি ছাড়া আর কেউ জাতীয় কবির কবিতার আবৃত্তির ওপর বই লিখেছেন আমাদের জানা নেই। তিনি নজরুল ইনস্টিটিউট প্রবর্তিত ‘নজরুল আবৃত্তি কোর্স’-এর সিলেবাস ও পাঠ্যক্রম প্রণেতা। শুধু এ বিষয়ে বই লিখেই তিনি থেমে থাকেননি। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যের বাচিক চর্চা ও বিকাশের জন্য তারই নেতৃত্বে ২০০৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বাংলাদেশ নজরুল আবৃত্তি পরিষদ’ নামের সংগঠন, যা আজ অবধি সক্রিয় রয়েছে। এ ছাড়াও তিনি রচনা করেন ‘ইসলামে শিল্পকলা-সাহিত্য-সংস্কৃতি’ নামে একটি অনন্য সাধারণ বই, যা ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ প্রকাশ করে। স্বকণ্ঠে তার নয়টি আবৃত্তির অডিও সিডি-ক্যাসেট প্রকাশিত হয়। আবৃত্তি শিল্পের বরপুত্র, অবিস্মরণীয় আবৃত্তি গবেষক-লেখক নাসিম আহমেদ নিয়মিত আবৃত্তি প্রশিক্ষক ও বিচারক হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। আবৃত্তি শিল্পের প্রাণিত পুরুষ, নাসিম আহমেদ বাষট্টি হেমন্তে আরোহণ করেছেন ২১ অক্টোবর। তাকে হৃদয় নিংড়ানো ও মনমথিত শুভেচ্ছা, ভালোবাসা। মহান আল্লাহর কাছে তার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু প্রার্থনা করছি।

পাঠকের মন্তব্য Login Registration