আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের কবি মানস

প্রতিনিধি | সাহিত্য

বৃহস্পতিবার ২৪ অক্টোবর ২০১৯|১৭:৫৬:০৭ মি.


ফারুক মোহাম্মদ ওমর

বাংলা বাঙালি ও বাংলাদেশির নিজস্ব সাংস্কৃতিক বিশ্বাসের কথা সামনে এলে এসে যাবে আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের নাম। যিনি আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্য-অন্বেষার প্রাজ্ঞপুরুষ। যার অদম্য মনোবল আর ত্যাগের বিনিময়ে সহস্রাধিক লুপ্তপ্রায় পুঁথি বাংলা সাহিত্য টিকে আছে। যার মধ্যে মুসলিম রচিত পুঁথির সংখ্যা ৫৯৭ এবং হিন্দু রচিত পুঁথির সংখ্যা ৩৮১টি। এর মাধ্যমে প্রায় দেড় শতাধিক অজানা নতুন কবির সন্ধান পেয়েছিলো বাংলা সাহিত্য। তাই এ থেকে বোঝা যায় আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ কতো উঁচুমাপের কবিমানসের অধিকারী ছিলেন এই ব-দ্বীপে।
তাঁর জ্ঞানের প্রধান ভিত্তি ছিল স্বদেশের মাটি। উদারতার ছাপ পাওয়া যায় তাঁর লেখার চরণে চরণে। গভীর উপলব্ধির শিখা জ্বলজ্বল করছে আমাদের চোখ বরাবর। তাঁর লেখায় এক প্রদীপ্ত চেতনার আলো। যে আলোয় পথ চিনে বাংলার ভাগ্যহারা মুসলমানরা স্বদেশকে ফিরে পেয়েছে। যা আমাদের এক সমন্বয়বাদী অসাম্প্রদায়িক বাঙালিত্ব বোধ এবং ধর্মীয় জীবনচেতনার মধ্য থেকে ওঠে আসা মনুষ্যত্বের উপলব্ধির কথা মনে করিয়ে দেয়।
আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ চারটি পত্রিকার অবৈতনিক সম্পাদক ছিলেন। এ কথা সর্বজন স্বীকৃত যে তাঁর সাহিত্যখ্যাতিই তাঁর এই সম্মান লাভের একমাত্র কারণ। বাঙালি জাতিসত্তা নির্মাণের অন্যতম পথিকৃৎ আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দের ১০ অক্টোবর চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার সুচক্রদ-ী গ্রামে পিতৃবিয়োগের তিন মাস পরে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মুন্শী নূরউদ্দিন মা মিসরীজান। ১১ বছর বয়সে ১৮৮২ খিস্টাব্দে চাচাতো বোন বদিউন্নিসাকে বিয়ে করেন। সুচক্রদ-ী গ্রামে শুরু হয় তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা। পটিয়ার ইংলিশ স্কুল থেকে ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এফ.এ. পড়ার জন্য চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হয়েও সন্নিপাত রোগের কারণে উচ্চশিক্ষার পাঠ চুকে যায়। জীবনের জন্য তাঁকে বিচিত্র পেশায় নিয়োজিত থাকতে হয়েছিল। তবে শিক্ষকতাকে অগ্রগণ্য বিবেচনা করেন সাহিত্য বিশারদ। ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল স্কুলে কিছুদিন শিক্ষকতা করার পর সীতাকু- মধ্য ইংরেজি স্কুলের প্রধান শিক্ষকের অস্থায়ী পদে যোগদান করেন। পরে ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামের প্রথম সাব-জজ আদালতে করণিক পদে চাকরি করতে থাকেন। এসময় কবি নবীনচন্দ্র সেনের সহযোগিতায় ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম কমিশনার অফিসে কমিশনারের পার্সোন্যাল এসিস্ট্যান্ট হয়ে আসেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষের বিরাগভাজন হয়ে চাকরিচ্যুত হন। এরপর ১৮৯৯ খিস্টাব্দে চট্টগ্রামের আনোয়ারা মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদে নিযুক্তি লাভ করেন। আবারও চাকরি বদল করে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্কুল অফিসে কেরানির পদে চাকরি করেন এবং ১৯৩৪ খিস্টাব্দের ১৫ ফেব্রুয়ারি পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
আবদুল করিম অবসর-জীবনে সাহিত্যসেবা ছাড়াও জনকল্যাণমূলক কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি স্থানীয় ইউনিয়ন বোর্ডের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট এবং পটিয়া আঞ্চলিক ঋণসালিশি বোর্ডের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আজীবন সাহিত্য অনুরাগী এই কবি মানস বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সহ-সভাপতি (১৯১৯), কলকাতা মুসলিম সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতি (১৯৩৯), চট্টগ্রাম সংস্কৃতি সম্মেলনের সভাপতি (১৯৫১) এবং কুমিল্লা সংস্কৃতি সম্মেলনের সভাপতি (১৯৫২) ছিলেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ট্রান্স ও বি.এ. পরীক্ষার বাংলার পরীক্ষক এবং ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা অনার্সের প্রশ্নকর্তা ও পরীক্ষক ছিলেন। আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ কোহিনূর, নবনূর, সওগাত এবং সাধনা এই পত্রিকাসমূহ সম্পাদনা করেন। যা সে সময় ব্যাপক 
মধ্যযুগের হিন্দু-মুসলমান সাহিত্য সাধকদের পান্ডুলিপি সংগ্রহ করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দান করেন। তিনি যদি ব্যক্তিগত উদ্যোগে সংগ্রহ না করতেন তা হলে আজ হয়তো বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হত। আর মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে মুসলমানদের অবদান সম্বন্ধে আমরা কিছুই জানতাম না। প্রথম মুসলিম পুঁথি সংগ্রাহক হিসেবে আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ সকল প্রকার সাম্প্রদায়িক মনোভাবের ঊর্ধ্বে থেকে পুঁথি সংগ্রহ ও সংকলন এবং সংরক্ষণ করেছিলেন। তাঁর সংগৃহীত পুঁথির সংখ্যা প্রায় দুই হাজার। এর মধ্য প্রায় একহাজার পুঁথি সাহিত্য বাঙালি মুসলমানদের রচিত। তাঁর সংগৃহীত মুসলিম রচিত ৫৯৭টি পুঁথি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং হিন্দু রচিত ৪৫০টি পুঁথি রাজশাহী বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। তিনি যেভাবে পুঁথি সংগ্রহ এবং সাহিত্য চর্চা করেন তা ধ্যানমগ্ন না হলে সম্ভব হতো না। যা তাঁর কবি মানসের সার্থক চিত্র ফুটে উঠে। তাঁর কাছে মুসলমান সমাজের ঋণ যে কত বড় তা ভাষায় বর্ণনা করা যাবে না। ভাষাতত্ত্ববিদ ড. মুহম্মদ এনামুল হক তাঁর ঋণ স্বীকার করে বলেন- ‘পাশ্চাত্য শিক্ষার আলোকে প্রদীপ্ত হইয়া এই দেশের হিন্দুদের মধ্যে যে জাতীয়তাবোধ ও তাহার ফলস্বরূপ জাতীয় বিলুপ্ত ঐতিহ্য সন্ধান ও উদ্ধারের স্পৃহা জাগিল, তাহাতে রাশি রাশি বাংলা পুস্তক ও পা-ুুলিপি সংগৃহীত হইয়া গেল। তাহার সাথে দুই চারটি মুসলিম- পুঁথিও উদ্ধার পাইল না, তাহা নহে, সংগ্রহের প্রেরণায় মুসলমানদের বাড়ী হইতে মুসলিম-পুঁথি সংগৃহীত হইল না। ইহার জন্যই বাংলার মুসলমানদের এক বিরাট জাতীয় সম্পদ ধ্বংস হইয়া যাইতে লাগিল। এ সময় মরহুম আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ সাহেবের আবির্ভাব (১৮৬৯-১৯৫৩) না ঘটিলে প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে আমরা নিশ্চিহ্ন হইয়া যাইতাম’।
সাহিত্যিক আবদুল হক চৌধুরীকে লেখা তাঁর চিঠি তাঁর কবি মানসের প্রমাণ পাওয়া যায় এভাবে -‘আমি মোস্লেম রচিত প্রাচীন বঙ্গ সাহিত্য পরিচয় নাম দিয়া প্রাচীন পুঁথির বিবরণ প্রকাশের উদ্দেশ্যে কয়জন ধনীর কাছে সাহায্য ভিক্ষা চাহিয়াছি। কিন্তু ধনীরা যতই ধনবান হউক, সাহিত্যের মর্যাদা বুঝে না। তাই তাদের কাছে কিছু পাইবার আশা করি না। সুতরাং পূর্বপাকিস্তানের মারফত সাধারণের কাছে ভিক্ষার ঝুলি ধরিয়াছি। সকলে ২/৪ টাকা করিয়া দিলে আমার অভীষ্ট সিদ্ধ হইবে।”
সতেরো শতকের কবি আলাওলের পদ্মাবতী ও অন্যান্য কাব্যের পুঁথি উদ্ধার, পুথিঁ পরিচিতিসহ তথ্যসমৃদ্ধ বহু প্রবন্ধ তাঁর সাহিত্য গবেষণায় সর্বশ্রেষ্ঠ হীরকদ্যুতি হিসেবে বিবেচিত। যা নতুন প্রজন্মের সাহিত্য অনুরাগীর জন্য এক আলোকবর্তিকা। ১৯০১ সাল থেকে ১৯১৭ সালের মধ্যে তিনি (নয়) ৯টি পুঁথি সম্পাদনা করেন। এগুলো পরবর্তীতে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ কর্তৃক প্রকাশিত হয়। পুঁথিগুলো হলো : নরোত্তম ঠাকুরের রাধিকার মানভঙ্গ (১৩০৮), কবি বল্লভের সত্যনারায়ণের পুঁথি (১৩২২), দ্বিজ রতিদেবের মৃগলুব্ধ (১৩২২), রামরাজার মৃগলুব্ধ সংবাদ (১৩২২), দ্বিজমাধবের গঙ্গামঙ্গল (১৩২৩), আলী রাজার জ্ঞানসাগর (১৩২৪), বাসুদেব ঘোষের স্ত্রী গোরাঙ্গ সন্ন্যাস (১৩২৪), মুক্ত রামসেনের সারদামঙ্গল (১৩২৪), এবং শেখ ফয়জুল্লাহর গোরক্ষবিজয় (১৩২৪)।  পুঁথি সংগ্রহ এবং সম্পাদনা ছাড়াও নানামুখী চিন্তা-চেতনামূলক তাঁর প্রায় ৪১২টির মতো মৌলিক প্রবন্ধ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। যেখানে তাঁর অগাধ পা-িত্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ইসলামাবাদ (চট্টগ্রামের চিত্র ইতিহাস) এবং আরাকান রাজসভায় বাঙ্গালা সাহিত্য (মুহম্মদ এনামুল হকের সঙ্গে যৌথভাবে) তাঁর দু’টি মৌলিক গদ্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। তাঁর অসাধারণ সাহিত্যকৃতির স্বীকৃতিস্বরূপ চট্টল ধর্মম-লী ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে সাহিত্যবিশারদ এবং নদীয়া সাহিত্যসভা ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে সাহিত্যসাগর উপাধি প্রদান করে। গবেষণাকর্মে অবদান রাখার জন্য ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ সরকার স্বাধীনতা পুরস্কার (মরণোত্তর) প্রদান করে। এই ঐতিহ্যপ্রেমী অগ্রপথিক আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে ৩০ সেপ্টেম্বরে নিজ গ্রামের বাড়িতে শেষ নিঃশেষ ত্যাগ করেন। পরে মসজিদের পাশেই তাকে সমাহিত করা হয়। তাঁর জীবন ও কর্ম সম্পর্কে প্রকাশিত গ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে বাংলা একাডেমি ফরহাদ খান ও সৈয়দুর রহমান সম্পাদিত আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদকে নিবেদিত প্রবন্ধ সংকলন (১৯৯৪), ইসরাইল খান সম্পাদিত আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ অভিভাষণসমগ্র (২০১০), আহমদ শরীফ রচিত আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ জীবনী গ্রন্থ’ (২০০২) এবং আবুল আহসান চৌধুরী সম্পাদিত আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ রচনাবলী ( ২০১৩) প্রকাশ করে।
এই গুণী সাহিত্য সাধকের জীবনের ৮৩ বছরের মধ্যে ৬৫ বছরেরও বেশী সময় ধরে প্রায় বিলুপ্ত, দুলর্ভ ও অজ্ঞাত প্রাচীন পুঁথি সংগ্রহ, সম্পাদনা ও তার ভিত্তিতে মধ্যযুগের কবি ও কাব্য সম্পর্কে দীর্ঘ ভূমিকা সহ আলোচনা ও বিশ্লেষন আমাদের বাংলা সাহিত্যকে পরিপূর্ণতা এনে দিয়েছেন। যা এক একজন বাঙালি মৌলিক কবি মানসের চিন্তা এবং শ্রম আমাদেরকে সমৃদ্ধ করে।
 

পাঠকের মন্তব্য Login Registration