অনুশোচনা

প্রতিনিধি | সাহিত্য

শনিবার ১৯ অক্টোবর ২০১৯|১১:২৯:৪৯ মি.


আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী

মানিকনগর শহরের নামানুসারে মানিকনগর কলেজের নামকরণ করা হয়েছিল। পাবনা জেলায় অবস্থিত ছোট এই মফস্বল শহরটি গড়ে উঠেছিল গত শতাব্দীর গোড়ার দিকে পদ্মা নদীর তীরে। এখানকার রেলওয়ে জংশনটিও অতি পুরাতন। এই শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত পদ্মা নদীর উপর হার্ডিঞ্জ ব্রিজতৈরি হয়েছিল ইংরেজ শাসনামলে। এখন থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগেও এই শহরের জনসংখ্যা তেমন একটা বৃদ্ধি পায়নি। রেলওয়ের একটি বড় জংশন স্টেশন ও ওয়ার্কশপ এবং ছোটখাটো ব্যবসা-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত। সরকারি, বেসরকারি কিছু অফিসও কালক্রমে এখানে স্থাপিত হয়েছে। বলা চলে সব মিলিয়ে মানিকনগর একটি ছোট ছিমছাম সুন্দর মফস্বল শহর যার স্নিগ্ধ শান্ত পরিবেশ তখনও বজায় ছিল।

মানিকনগর হাইস্কুল বেশ পুরাতন; প্রায় একদশক আগে শতবর্ষপূর্ণ করেছে। স্কুলের পাশেই স্থাপিত হয়েছে মানিকনগর কলেজ গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে। তরুণ অধ্যাপক আশেকুজ্জমান মিয়া এই কলেজে যোগদান করেন ষাটের দশকের শুরুর দিকে এবং এর বছর দুয়েক পরে যোগ দেন প্রফেসর মুহিবুর রহমান। কলেজের ছাত্রসংখ্যা সবমিলিয়ে পাঁচ হাজারের কম হবে না। সে অনুপাতে শিক্ষকের সংখ্যা অপ্রতুলই ছিল বলা চলে। আশেকুজ্জমান মিয়া ছিলেন দর্শনের প্রফেসর আর মুহিবুর রহমান ছিলেন বাংলার প্রফেসর। ছাত্রজীবনে দুজনেই প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন; মার্কসবাদ রপ্ত করেছিলেন। মুহিবুর রহমান তখনকার নক্সাল আন্দোলনের প্রাণপুরুষ কমরেড চারুমজুমদারের ভক্ত ছিলেন এবং এ বিষয়ে একটি পুস্তকও রচনা করেছিলেন। তবে চাকুরীসূত্রেই এখানে তাদের পরিচয়। একই আদর্শে বিশ্বাসের কারণে তাদের সম্পর্ক ছিল ঘনিষ্ঠ। 

পদ্মা নদীর তীর থেকে স্কুল, কলেজের দূরত্ব বড়জোর মাইলখানেক হতে পারে। বিকেলবেলায় দুই বন্ধু বেড়াতে আসতেন এখানে; প্রাণভরে উপভোগ করতেন পদ্মার অপরূপ রূপ, আশপাশের নৈসর্গিক সৌন্দর্য। সন্ধ্যা নেমে এলে ফিরে আসতেন বাসগৃহে। দুজনেই শহরের একটি অপেক্ষাকৃত নতুন আবাসিক এলাকা ‘ঝিলমিল’-এ বসবাস করতেন। স্কুল, কলেজের ও অন্যান্য চাকুরীতে কর্মরত প্রায় দুইশত পরিবারের বসবাস ছিল এই আবাসিক এলাকাটিতে। মোটামুটি কেউ কারও একেবারেই অজানা, অপরিচিত ছিল না। প্রতিবেশীদের মধ্যে সুসম্পর্ক বিরাজমান ছিল। কলেজে পাঠদান, ক্লাশের ফাঁকে শিক্ষক কমনরূমে আড্ডা আর বিকেলে পদ্মারপাড়ে বেড়ানো এবং কোন কোন সন্ধ্যায় অফিসার্স ক্লাবে গমন—এভাবেই কেটে যায় মিয়া সাহেব ও তার বন্ধু সহকর্মীদের জীবন। অবশ্য ইতোমধ্যে মুহিবুর রহমান বিয়ে করে ঘরসংসার শুরু করলেও আশেকুজ্জমান সাহেব সে পথে পা বাড়াননি। কোন এক অজ্ঞাত কারণে তিনি চিরকুমারই থেকে যান। এ পাড়ায় বসবাসের আগে তিনি শহরের অন্যপ্রান্তে আরেকটি আবাসিক এলাকা ‘শিমুলিয়ায়’ বাস করতেন। ‘শিমুলিয়া’ শহরের সবচেয়ে পুরানো আবাসিক এলাকা। মূলত এটি নিয়ে মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারে অধ্যুষিতপাড়া।

প্রফেসর আশেকুজ্জমান মিয়া চাকুরীর শুরুতেই এ পাড়ায় বাসা ভাড়া নেন—বাসাটি ছিল তিন কক্ষ বিশিষ্ট টিনের বাঙলোঘর। পাশের বাড়িটি ছিল হাশেম আলী নামক এক রেল কর্মচারীর। রেলে হাশেম আলীর চাকুরী অনেক দিনের। জীবনের অনেকটা সময় এখানেই কাটিয়ে দিয়েছেন; যোগ্যতা থাকলেও অন্যত্র আরেকটু ভাল চাকুরীর চেষ্টা করেননি। যেমন আছেন তাতেই সন্তুষ্ট। হাশেম আলীর তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে রেবেকা তখন স্কুলের উপরের ক্লাশের ছাত্রী, ছোটমেয়ে নাজমা এবং সবচেয়ে ছোট ছেলে রফিকও স্কুলগামী। হাশেম আলীর স্বল্প শিক্ষিত স্ত্রী একজন আদর্শ গৃহবধূ। চাকুরীসূত্রেই হাশেম আলীর মানিকনগরে আগমন এবং অনেকটা স্থায়ীভাবে বসবাস, যদিও তার পৈতৃক নিবাস রাজশাহীর গোদাগাড়িতে। শিমুলিয়ার এই ভাড়া বাড়িতেই ছেলেমেয়ে নিয়ে একপ্রকার সুখ-শান্তিতেই কালাতিপাত করছিলেন।

পাশের বাড়িতে প্রফেসর আশেকুজ্জমানের আগমনের প্রথম দিনেই খোঁজখবর নিতে এলেন হাশেম আলী—কোন অসুবিধা হচ্ছে কিনা, কোন কিছুর প্রয়োজন আছে কিনা জানতে চাইলেন। প্রথম রাতের খাবারটা তার বাসা থেকে পাঠাবেন বলে জানালেন কারণ রান্না-বান্না শুরু করতে মিয়া সাহেবের বাবুর্চির যে সময় লাগতে পারে। এ বাসায় মিয়া সাহেব প্রায় তিন বছর ছিলেন। এ সময়ের মধ্যে হাশেম আলী পরিবারের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপিত হয়। অবসর সময়ে আশেকুজ্জমান নিঃসঙ্কোচে প্রতিবেশীর বাড়িতে উপস্থিত হতেন, হাশেম আলীর সাথে গল্প-গুজব করে বাসায় ফিরতেন। মিয়া সাহেব হাশেম আলীর সন্তানদের অত্যন্ত স্নেহ করতেন। কখনও কখনও তাদের জন্যে মিষ্টি, বিস্কিট ও চকলেট জাতীয় খাবারও কিনেছেন। ছেলেমেয়েরা তাকে চাচা ডাকতেন। এভাবে তিনি হাশেম আলী পরিবারের একান্ত আপনজন হিসাবে আবির্ভূত হন।

কিন্তু একসময় তিনি মানিকনগর কলেজ সংলগ্ন নতুন গড়ে উঠা ‘ঝিলমিল’ আবাসিক এলাকায় বাসা ভাড়া নেন। যাতায়াতের সুবিধার্থে এবং সহকর্মীদের কাছাকাছি বসবাস করার উদ্দেশ্যে তিনি বাসা বদল করেন। নতুন বাসস্থানে আসার পর হাশেম আলীর বাসায় তার আর তেমন একটা যাতায়াত ছিল না; তবে আসা-যাওয়া একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়নি। প্রফেসর আশেকুজ্জমান ইতোমধ্যে ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেন, কলেজের প্রশাসনিক ও অন্যান্য কাজের সাথে যুক্ত হন। এর ফলে তার ব্যস্ততা বেড়ে যায়। ইচ্ছা থাকলেও এ কারণে হাশেম আলীর বাসায় যেতে পারেননি; অন্যদিকে হাশেম আলী, বিশেষ করে তার ছেলেমেয়েরা একাধিকবার মিয়া সাহেবের বাসায় বেড়াতে এসেছে। প্রফেসর মুহিবুর রহমান পরিবারসহ অদূরেই বাস করতেন—মাত্র তিন-চার মিনিটের পথ। তাই অনেকটা নিয়মিতভাবেই তারা একে অপরের বাসায় আড্ডা দিতেন। কখনও বা ‘ঝিলমিলে’ বসবাসরত অন্যান্য বন্ধু-সহকর্মীদের বাড়িতেও আসা-যাওয়া ছিল।

কিন্তু মানবসমাজে সবসময় সবকিছু সমান্তরাল রেখায় সংঘটিত হয় না। এক ছুটির দিনে পড়ন্ত বিকেলে আশেকুজ্জমান তার বাসায় বন্ধু মুহিবুর রহমানের সাথে গল্প করছিলেন। চা খেতে খেতে দুজনেই দেশের সমস্যা আলোচনায় মগ্ন ছিলেন। এ সময় হন্তদন্ত হয়ে একটি যুবতী তার বাসায় প্রবেশ করেন এবং মিয়া সাহেবকে সম্বোধন করে বলেন—
চাচা, আপনার সাথে একটু জরুরী কথা আছে।
মিয়া সাহেব লক্ষ্য করলেন এ যে হাশেম আলীর বড় মেয়ে রেবেকা—কিছুটা বিস্মিত হলেন তার উস্ক-খুশকো চুল ও বিষণ্ন বদন দেখে। 

মিয়া সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন : কোথা থেকে আসলে? কি হয়েছে? এ ঘরে বসবে নাকি পাশের ঘরে?

রেবেকা : আমি পাশের ঘরে যাচ্ছি। আপনি আসুন। (সম্ভবত: অপরিচিত মুহিবুর রহমানের সম্মুখে সে কথা বলতে চাইছিল না।)
আশেকুজ্জমান : তুমি ওই ঘরে বস, আমি এখনই আসছি।
এ পর্যায়ে মুহিবুর রহমান মিয়া সাহেবের বাসা থেকে বেরিয়ে আসলেন যদিও মিয়া সাহেব তাকে বারবার আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলছিলেন।
রেবেকা এর মধ্যে বি.এ পাশ করেছে এবং দুই-আড়াই বছর আগে তার মা, বাবা, আত্মীয়-স্বজন পাত্র নির্বাচন করে তাকে বিয়ে দিয়েছেন। পাত্র শিক্ষিত এবং স্থানীয় একটি প্রতিষ্ঠানে চাকুরীরত। 
অনেকের সাথে মিয়া সাহেবও সে বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন। মুহিবুর রহমান চলে গেলে মিয়া সাহেব পাশের ঘরে রেবেকাকে জিজ্ঞেস করলেন—
কি হয়েছে? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?
রেবেকা : ও (অর্থাৎ রেবেকার স্বামী) আমাকে মেরেছে। এবারই প্রথম নয়। এর আগেও কয়েকবার প্রহার করেছে। তাই আমি বেরিয়ে এসেছি, অন্তত, আজ আর ফিরে যাব না।
আশেকুজ্জমান : অত্যন্ত দুঃখ পেলাম। আমি অত্যন্ত দুঃখিত। কেমন করেএকজন শিক্ষিত ছেলে এমন আচরণ করে আমি বুঝতে পারছি না। তোমার মা-বাবা’কে জানিয়েছ?
রেবেকা : না। জানিয়ে লাভ নেই। মা-বাবার এক কথা ‘তুই মানিয়ে চল’। ঝগড়া করিস না। ঠিক হয়ে যাবে।
আশেকুজ্জমান : না, না- এ কি করে হয়? এর একটা বিহীত হতে হবে। তুমি শান্ত হও। চা-নাস্তা খাও। 

রেবেকা : শুধু পানি খাব। ছেলেটাকে বলেন (অর্থাৎ কাজের ছেলেটিকে) শুধু পানি দিতে। এই বলে অঝোরে কান্নায় ভেঙে পড়ে।
মিয়া সাহেব অত্যন্ত বিচলিত হন। বলেন—তুমি তোমার বাবার বাসায় যাও এবং মা-বাবাকে অবহিত কর।

রেবেকা : আমি বাবার বাসায় যাব না। তারা কিছুই করতে পারবেন না। তারাও কান্নাকাটি করবেন।

আশেকুজ্জমান: সন্ধ্যা নেমেছে। তাহলে কি করবে?

রেবেকা : আজ রাতটা আপনার বাসায় আমাকে আশ্রয় দেন। কাল সকালে না হয় অনত্র চলে যাব।

মিয়া সাহেব এতে আরও বিচলিত ও চিন্তিত হয়ে পড়েন। তার যে পরিবার নাই। অতএব এ যে সম্ভব নয়। তিনি বলেন :
আমার বাসাতে আর কোন মেয়ে থাকে না। তুমি তো জান আমি অবিবাহিত, আমার পরিবার নাই। এমতাবস্থায়, তুমি এখানে কেমন করে রাত্রিযাপন করবে! এতে আমার ও তোমার দুজনেরই দুর্নাম হবে এবং এ নিয়ে কুৎসা রটনা হবে।

রেবেকা : আমি তো আপনার মেয়ের মত। এতে কি এমন হবে?

আশেকুজ্জমান: তুমি বয়সে এখনও তরুণ। তুমি এ সমাজকে এখনও চিন না। এটা সম্ভব নয়।

এরপর রেবেকা আরও কিছুক্ষণ সেখানে চুপ করে বসে থাকে। কিছু খেতে দিতে চাইলে রেবেকা খেতে অস্বীকৃতি জানায়। অবশেষে আর এক গ্লাস পানি খেয়ে মিয়া সাহেবের বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ে।

পরদিন সকালে মিয়া সাহেব স্থানীয় দৈনিক পত্রিকার শেষ পৃষ্ঠায় ছবিসহ রেবেকার আত্মহত্যার খবর দেখতে পান। দুঃখ-বেদনায় মুষড়ে পড়েন। ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ছুটে যান শিমুলিয়ায় রেবেকার বাবার বাসায়। তার মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের আহাজারিতে শিমুলিয়ার আকাশ বাতাস ততক্ষণে ভারী হয়ে উঠেছে। একজন তরুণীর এহেন করুণ পরিণতিতে সকলেই শোকাহত, ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ। রেবেকার অসহায় পিতা, মাতা, ভাইবোনদের সান্ত¡না দেওয়ার ক্ষমতা ও ভাষা আশেকুজ্জমান মিয়া তখন হারিয়ে ফেলেছেন।

মিয়া সাহেব বিষয়টি বন্ধু মুহিবুর রহমানকে একটু ক্ষোভের সাথে জানান, কারণ তিনি মনে করেন মুহিবুর রহমান সে সময় তার বাসা থেকে চলে না এলে হয়ত রেবেকার রাতে থাকার একটা ব্যবস্থা অন্তত মুহিবুর রহমানের পরিবারের সাথে করা যেতে পারতো। মুহিবুর রহমান মিয়া সাহেবের মানসিক অবস্থা অনুধাবন করে নিরুত্তর থাকেন। পরিবার-পরিজনহীন প্রফেসর আশেকুজ্জমান মিয়ার জীবনে এটি একটি দুঃখজনক ও মর্মান্তিক ঘটনা। তিনি ভাবতে থাকেন এ ঘটনায় তার কোন দায় আছে কিনা! একটি অপরাধবোধ তার মধ্যে কাজ করতে থাকে। কিন্তু রেবেকার আত্মার শান্তি কামনা করা ছাড়া যে তার আর কিছু করার ছিল না। মিয়া সাহেব এরপরও বহুদিন বেঁচে ছিলেন। কিন্তু এ দুঃখজনক ঘটনা তিনি কখনও ভুলতে পারেননি। একটা কষ্ট তাকে তাড়া করেছে—কেন তিনি রেবেকাকে সে রাতে আশ্রয় দিতে অস্বীকৃতি জানালেন। তিনি সারাজীবন এজন্যে দুঃখবোধ করবেন ও অনুতপ্ত থাকবেন—এটাই যেন তার মানসিক শাস্তি। এলবেটট্রস পাখি বধকারী প্রাচীন সে নাবিকের মতই হয়েছে তার পরিণতি। এলবেটট্রস পাখি বধ করে প্রাচীনকালের সে নাবিক মানবজীবনের এক অলিখিত বিধি লঙ্ঘন করেছিলেন। আর প্রফেসর আশেকুজ্জমান মিয়া এক অসহায় তরুণীকে বিপদে আশ্রয় না দিয়ে মনুষ্যত্বের অবমাননা করেছিলেন—তাই তার শাস্তি শুধু অনুশোচনা।
 

পাঠকের মন্তব্য Login Registration