মানব জাতির নিশ্চিহ্ন হওয়ার আশঙ্কা

প্রতিনিধি | সাহিত্য

বুধবার ১৬ অক্টোবর ২০১৯|১৬:৫৩:২৩ মি.


ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী

বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে-সঙ্গে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে। এতে করে পৃথিবীর বহু দেশের নিম্নাঞ্চল পানিতে ডুবে যাবে। বিশেষ করে, উপকূলবর্তী স্থানসমূহ নিমজ্জিত হবে। ফলে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব হবে আরো ভয়াবহ। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ও গণমাধ্যমে এ বিষয়ে খবর প্রচারিত হয়েছে। জাতিসংঘের একটি বিজ্ঞানী প্যানেল জলবায়ু পরিবর্তনের সুদূরপ্রসারী প্রভাবের এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছেন। এই প্রতিবেদনে বলা হয় অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন দ্রুতহারে সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে এবং বরফ গলছে। এর ফলে বিভিন্ন প্রজাতির জীবজন্তু তাদের আবাসস্থল বদলাচ্ছে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয় বরফ গলার ফলে সমুদ্রসংলগ্ন এক বিশাল অঞ্চল জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিশ্বের প্রায় ৪৫টি শহর সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে এবং এই ভয়াবহ বিপর্যয় মানবসৃষ্ট। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিজ্ঞানীরা এবার যা পেয়েছেন তা আগের প্রতিবেদনগুলোর তুলনায় অনেক বেশি ভীতিকর। জাতিসংঘ আইপিসিসি জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক আন্তর্জাতিক প্যানেলের বিজ্ঞানীরা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে পৃথিবীর ভবিষ্যত্ নিয়ে রেড অ্যালার্ট জারি করেছেন। এই জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ ও বিপজ্জনক প্রভাব মোকাবিলায় রাজনীতিকদের ওপর জনগণের চাপ বাড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

এই প্রতিবেদন সারাবিশ্বে তোলপাড় সৃষ্টি করে। জাতিসংঘের সদর দপ্তরে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে ষোলো বছরের এক তরুণী গ্রেটা থানবার্গ বিশ্ব পরিবেশ ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ফেটে পড়েন। এই মেয়েটি সুইডেনের নাগরিক এবং একটি স্কুলের ছাত্রী। তার এই সাহসী প্রতিবাদ এবং হুংকার বিশ্বনেতাদের নজর কাড়ে। গ্রেটার প্রতিবাদ বিশ্বের অসংখ্য মানুষের মধ্যে বিশেষ করে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করে এবং গ্রেটা বিকল্প নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন।

জলবায়ুর পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব সম্পর্কে কম-বেশি বিশ্ববাসী যে অবহিত ছিল না এমন কথা বলা যাবে না। এই নিয়ে গত প্রায় দু-তিন দশক যাবত্ আলোচনা, সমালোচনা, প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধের নানা ঘটনা ও কাহিনি সম্পর্কে আমরা জ্ঞাত। পরিবেশবাদীরা বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছেন। কিন্তু পরিবেশ দূষণের জন্য মূলত যারা দায়ী সেই শিল্পোন্নত দেশগুলোর এতে টনক নড়েনি। বায়ুদূষণ তথা পরিবেশদূষণ ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলেছে। তাতে করে পৃথিবীর মানুষ এক ভয়াবহ পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

প্রতি বছরের মতো এবারও জুন-জুলাই মাসে আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ছিলাম। এবার সেখানে থাকাকালীন দুটি বিষয়ের প্রতি আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। সেখানকার সুশীল সমাজের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় বুঝতে পারি যে, (১) মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং ভবিষ্যতে আরো বৃদ্ধি পাবে। এর কারণ চিকিত্সাশাস্ত্র ও গবেষণার ক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নয়ন। জরাবিজ্ঞানের (Geneontology) ব্যবস্থাপত্র এবং স্বাস্থ্য সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি। ধারণা করা হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আজ যে শিশু জন্মগ্রহণ করছে—সে হয়তো আগামী ২০০/২৫০ বছর বেঁচে থাকবে। মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধির এ খবর নিঃসন্দেহে আনন্দের। (২) কিন্তু মানব জাতির জন্যে যে দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে তা হলো, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের ফলে আগামী ১০০/১৫০ বছরের মধ্যে মানবজাতি পৃবিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমার পরিচিত বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আলাপকালে আমি তাদের উদ্বেগ, উত্কণ্ঠা লক্ষ্য করি। এবং এ বিষয়ে আরো তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের চেষ্টা করি। দেশে ফিরে এ বিষয়ে লেখার তাগিদ অনুভব করি যেন আমি আমার সংগৃহীত তথ্যাদি আমার দেশের মানুষের কাছে উপস্থাপন করতে পারি। এর মধ্যে ‘Summary for Policymakers’ জাতিসংঘের ৭৪তম সাধারণ অধিবেশনের সংশ্লিষ্ট কমিটিতে আলোচিত হয়। এই প্রতিবেদনটির পুরো নাম হলো “Global Warming of 1.5c, an IPCC special report on the impacts of global warming of 1.5c above pre-industrial levels and related global greenhouse gas emission pathways, in the context of strengthening the global response to the threat of climate change, sustainable development, and efforts to eradicate poverty”. পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রায় ৬০ জন বিজ্ঞানী এই অফিসিয়াল IPCC-২০১৮ জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। নীতিনির্ধারকরা এর একটি সার-সংক্ষেপ তৈরি করেছেন এবং এই প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবস্থা না করলে পৃথিবী নামক এ গ্রহের যে ক্ষতি হবে তা আর পূরণ করা সম্ভব হবে না। বিজ্ঞানীদের এই প্রতিবেদনের মূল কথা হলো বৈশ্বিক তাপমাত্রা এ শতাব্দীতে যদি ১.৫ ডিগ্রির নিচে না রাখা যায় এবং ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ ৪৫ ভাগ না কমানো যায় তাহলে বিশ্বমানব এক বিরাট হুমকির সম্মুখীন হবে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয় ‘‘Climate-related risk to health, livelihoods, food security, water supply, human security, and economic growth are projected to increase with global warming of 1.5c and increase further with 2C”. এর অর্থ হলো বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রির বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্য, জীবিকা, খাদ্য নিরাপত্তা, পানি সরবরাহ, মানবিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি চরম ঝুঁকির মধ্যে পড়বে এবং বৈশ্বিক তাপমাত্রা দুই ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বৃদ্ধি পেলে এই ঝুঁকি আরো বেড়ে যাবে।

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব সম্পর্কে ইতিমধ্যে বিজ্ঞানীরা অনেক গবেষণা করেছেন। সংক্ষেপে নিম্নে তা তুলে ধরা হলো— ক. বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির আগাম বার্তা বিজ্ঞানীরা অনেক আগেই দিয়েছিলেন। ওজনস্তরের ছিদ্রের ফলে সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে মেরুর বরফ দ্রুত গলতে থাকে এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যায়। খ. এতে করে, পৃথিবীর বহু দ্বীপাঞ্চলের অধিবাসী এবং উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ বাস্তুহারা হবে। এই বাস্তুহারা মানুষ আশ্রয় পেতে অপেক্ষাকৃত উঁচু ভূমিকে বেছে নিবেন। ফলে সামাজিক ও রাজনৈতিক নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। গ. জলবায়ুর এ ধরনের পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর মানুষ বহু নতুন নতুন রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হবে। এবং এই ধরনের রোগব্যাধি মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এ সকল ব্যাধি থেকে পরিত্রাণের সহজ কোনো উপায় থাকবে না। ঘ. প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, খরা ইত্যাদির প্রকোপ বেড়ে যাবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে জানমালের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হবে। ঙ. জীববৈচিত্র্যের ধ্বংস ও পরিবর্তন অনেকটা অনিবার্য হয়ে উঠবে, যা মানববসতির অনুকূলে থাকবে না।

অতএব, এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় হলো— কার্বন নির্গমন বন্ধ করা : শিল্পোন্নত দেশগুলোতে বৃহত্ বৃহত্ শিল্পকারখানায় বিপুল পরিমাণে যে কার্বন নির্গমন হয় তাতে পরিবেশ দূষিত হয়। অতএব, শিল্পোন্নত দেশগুলো যদি কার্বন নির্গমন বন্ধের ব্যবস্থা না করে তাহলে পরিবেশ দূষণ অব্যাহত থাকবে। গ্রীনহাউজ প্রভাব বন্ধ করা : বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশে গ্রীনহাউজ থেকে যে গ্যাস নিঃসরণ হয় তাও পৃথিবীর পরিবেশকে দূষিত করে এবং উষ্ণতা বাড়িয়ে দেয়। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব মানবজাতির বেঁচে থাকার জন্য এক বিরাট হুমকি। তাই এ ব্যাপারে শিল্পোন্নত দেশগুলোকে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। এই ক্রমবর্ধমান কার্বন নির্গমনের কারণে এবং এতে সৃষ্ট জলবায়ুর উষ্ণতার কারণে উত্তর ও দক্ষিণ মেরুতে বরফের পাহাড় গলে সমুদ্রের পানি বাড়িয়ে দিচ্ছে। এর ফলে যে পরিবেশগত ও মানবিক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে তারই প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। সুইডিস তরুণী গ্রেটারের কথা আগেই উল্লেখ করেছি। গ্রেটা এরপর কানাডার মন্ট্রিল শহরে এক বিশাল র্যালিতে যোগ দিয়েছেন। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ঐ র্যালিতে যোগ দিয়েছেন এবং পরিবেশ রক্ষার জন্য এক বিলিয়ন গাছ লাগানোর ঘোষণা দিয়েছেন।

এই প্রতিবাদের ঢেউ আমাদের দেশেও লেগেছে। জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করতে না পারলে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল যে পানির নিচে তলিয়ে যাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এই পূর্বাভাস আমরা অনেক আগেই পেয়েছি। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্যে আমরা অতটা দায়ী না হলেও, এর বিরূপ প্রভাব থেকে আমাদের মুক্তি নেই। অতএব, আমাদেরকে আরো সচেতন হতে হবে এবং এর বিরুদ্ধে আরো শক্তিশালী প্রতিবাদ গড়ে তুলতে হবে। গ্রেটারের মতো আমাদের দেশে তরুণ-তরুণীরাও এই আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে বলে আমার বিশ্বাস। কিছুদিন আগে নটরডেম কলেজে ১০ম ন্যাশনাল ন্যাচার সামিট অনুষ্ঠিত হয়েছে। পত্রপত্রিকায় এ খবর দেখে আমি খুবই অনুপ্রাণিত হয়েছি। ন্যাশনাল ন্যাচার সামিটে যারা যোগ দিয়েছেন মনে হলো তারা অনেকেই তরুণ বয়সের। এ কথা হয়তো ঠিক যে, পরিবেশ দূষণকারীদের দায়িত্ব পরিবেশ পরিষ্কার ও সংরক্ষণ করা। কিন্তু তাদের দিকে তাকিয়ে থাকলে চলবে না। যুবা, বৃদ্ধা নির্বিশেষে আমাদের সকলকে আমাদের নিজেদের অবস্থান থেকে পরিবেশ রক্ষার জন্য কাজ করতে হবে। বিশেষ করে তরুণপ্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের দেশে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান যেমন, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন, ন্যাচার স্টাডি ক্লাব এবং আরো পরিবেশবাদী সংগঠন এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। তাদেরকে আমি সাধুবাদ জানাই। প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন এবং চ্যানেল আইতে এ বিষয়ে যে অনুষ্ঠানমালা প্রচার করা হয় তাতে পরিবেশ সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা আরো বৃদ্ধি পাবে বলে আমি আশা করি। আমাদের পরিবেশদূষণের অনেক কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বৃক্ষনিধন, প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার ইত্যাদি। এছাড়া আরো বহুবিধ কারণ রয়েছে। আমাদের জীববৈচিত্র্য সুরক্ষার অভাবও পরিবেশ বিপর্যয়ের আরেক কারণ। অতএব এসব ব্যাপারে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করে আমরা পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারি। আমাদের এই দেশ এবং পৃথিবী নামক এই গ্রহকে বাসযোগ্য রাখতে হলে পরিবেশদূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনকে রুখতে হবে। নতুবা মানব জাতিকে অন্য গ্রহে বিকল্প বাসস্থানের সন্ধানে নামতে হবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে পরিবেশ রক্ষার জন্যে এবং জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করার জন্যে বিশ্বব্যাপী এক সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার উদাত্ত আহবান জানাচ্ছি।

পাঠকের মন্তব্য Login Registration