ভোকাট্ট-৬২

প্রতিনিধি | সাহিত্য

বৃহস্পতিবার ৮ আগস্ট ২০১৯|১৫:০১:২৭ মি.


এনাম আহমেদ

দুপুরের রোদ চরের বালুর ওপর পরে উত্তাপ ছড়াচ্ছে। চর মোনাজাত, পদ্মারচর। হঠাৎ করেই ওখানে শুভ এবং তপুর টুকরো ভ্রমণ। বিনা নোটিশে ঢাকার বাইরে কোথাও বেরিয়ে পড়া। রোদের তেজ বেশি বলেই তারা একটা চালার নিচে এসে বসলো। দোকানী বৃদ্ধ মানুষটির মাথায় একটা গামছাবাঁধা। শূন্য দৃষ্টিতে চরের শেষে নদীর পানে তাকিয়ে। মুখের দাঁড়িতে ঢেকে আছে জীবনের নানা দুঃখের ছাপ। মুখের চামড়া কুঁচকে গেছে। সংগ্রামী মানুষেরা একটু সময়ের আগেই বুড়িয়ে যায়। তপুদের বসা মনে হয় বৃদ্ধ দোকানীর চোখেই পড়েনি। কেননা দোকানের সামনের টুলে তাদের বসা, দোকানীর উদাসী দৃষ্টির মধ্যে কোনো ছাপ ফেলেনি। 
দোকানটি একটি বহুমুখী ব্যবসা কেন্দ্র। লজেন্স, পান, সিগারেট, থেকে শুরু করে  ডাল-ভাতের ব্যবস্থাও রয়েছে। শুরুতেই শুভদা দোকানীর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা চালালো—
— চাচা, সিগারেট আছে?
— আছে তো।
— দেন, দুইটা বেনসন সিগারেট দেন।
— এই চরে বেনসন পাইবেন কই?
— তাহলে।
— বড়জোর গোল্ডলিফ সামনের দোকান থিকা যোগাড় কইরা দিতে পারি।
আসলে সিগারেট শুভদার পকেটেই ছিলো। শুধু দোকানীকে মানসিকভাবে দোকানে ফিরিয়ে আনতেই সিগারেট কিনতে চাওয়া।
— চাচা। আপনার এইখানে ভাত খাওয়া যাবে।
— তা যাবে। কিন্তু আপনারা ইরি চাইলের ভাত খাতি পারবেন তো?
— এই দুপুরে ওতেই হবে। এবার বলেন, আপনার এখানে তরকারি কি কি আছে?
— মাছ আর ডাইল পাবেন।
— মুরগি নেই।
— না, এই চরে তো তেমন কাস্টমার নাই। বেচাকেনা অইবে কেমনে?
— তা কী কী মাছ আছে?
— নদীর টেংরা, মাগুর মাছ, আর ইলিশ খাইতে চাইলে আইনা দেওন যাইবে।
— সবজি হবে?
— হেয়া কি? নিরামিষ? ওয়া অইবে না। এহন চিন্তা কইরা কন-এহানে ভাত খাইবেন কিনা?
— দুপুরে ভাত তো খাইতেই হবে। খুব ক্ষুধা লেগেছে।
— তয় বইয়েন। আত-মুখ ধুইয়া লন। ঐ হানে মটকার মইদ্যে পানি আছে। 
মটকায় মগ ডুবিয়ে পানি তুলে তারা হাত মুখ ধুয়ে নিলো। এই দুপুরের রোদে এক ধরনের প্রশান্তি এসে ভর করল। টেবিলে বসতেই টিনের থালা ভর্তি মোটা চালের ভাত ও টেংরা মাছের ঝোল এসে হাজির। খেতে খুব ঝাল। তারপরও অন্যরকম সুস্বাদ নদীর মাছে। শুভদা আরেক প্লেট মাছ চাইলেন। হোটেল মালিক তার রান্নার কারিশমা দেখানোর জন্য দু’জনের পাতেই এক টুকরা করে মাগুর মাছ তুলে দিলেন। যেনো হোটেল নয়; বাড়িতে অতিথি আপ্যায়ন করছেন। শুভদা থালার ভাত শেষ করে ফেললেন। আবারও ভাত এলো প্লেট ভর্তি, কিন্তু অতো ভাত খাওয়ার মতো সাহস ও শক্তি কারোই নেই। শুভ সামান্য নিলো। তপু একপ্লেট শেষ করতেই ঝালে ঘেমে নেয়ে উঠেছে। সামনে ডালের বাটি রয়েছে। তাও একটু চেখে দেখতে হবে। ডালের ওপর ভাসছে শুকনো মরিচ ভাজা। দেখেই লোভ হচ্ছে  চেখে দেখার।
খাওয়া শেষ হলে দোকানী ঝাল তাড়াবার জন্য মালাইসহ কাপ ভর্তি ঘন দুধ সামনে এনে হাজির করলেন। দোকানীর এ ধরনের আপ্যায়নে তারা দু’জনেই মুগ্ধ। যেন কোনো গরিব চাষি তার হৃদয় উজাড় করে মেহমানদারী করছেন। মনে হলো তারা যেন গাঁয়ের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। খাওয়া শেষে পান খেয়ে বিড়ি ধরিয়ে বসা হলো দোকানীর পাশে শুরু হলো মজিদের জীবনের গল্প। 
— মুই মোডামুটি ভালো অবস্থাই ছেলাম। জমিজমা বাপের আমল থিকা ভালোই আছেলে। সব জোয়ান কালে পদ্মায় কাইড়া নেছে। হেরপর বউ-পোলাপান, লইয়া খামু কি, চলমু কেমনে? হের লাইগা ধার-দেনা কইরা এই দোকান লইয়া বইছি। চরে কি মানু আহে? নদী পারাপারের সময় পান-বিড়ি কেনে, দুই চাইর প্যাকেট বিস্কুট বেচাকেনা অয়। আর দুপুরের সময় ভাতের কাস্টমার পাওয়া যায়। হেই-দিয়া কোনো রহম আল্লাহ চালায়।
— ছেলেমেয়ে বড় হয়নি? আপনাকে সাহায্যে করে না?
— পোলা এ্যাউক্কা, মাইয়া বড়। হেরে বিয়া দিছি। পোলায় মাঝে মাঝে দোহানে বয়। আর জমিজমার কাম করে। গল্পে গল্পে দুপুর গড়িয়ে গেলো। মজিদ দোকানেই খেতে বসে গেলো। তপুরা তার পাওনা মিটিয়ে পড়ন্ত সূর্যের আলোয় নদীর দিকে হাঁটা শুরু করলো।      
 

পাঠকের মন্তব্য Login Registration