শিকড়

প্রতিনিধি | সাহিত্য

বুধবার ১ আগস্ট ২০১৮|১৮:৫৯:০৫ মি.




ফরিদা হোসেন

আকাশে তখন মধ্য দুপুর।
চারদিক ঝাঁঝাঁ করছে রোদে।
ফেটে চৌচির হয়ে গেছে ক্ষেত খামার। নদীর পাড়, মানুষের পায়ে হাঁটা মেঠো পথ। সব...সব...।
বৈশাখের মাঝামাঝি।
কিন্তু নড়ছে না গাছের পাতাও।
মিরসরাই স্টেশনে ট্রেন থামলো এক সময়।
ছোট্ট স্টেশন—চারদিকে লোকজন আর ফেরিওয়ালাদের হাঁক ডাক।
যাত্রীদের ব্যস্ত উঠানামা, ছুটোছুটি।
এদিক সেদিক তাকিয়ে দু’হাতে হ্যান্ডেল ধরে পাদানীতে এক পা এগিয়ে দিল মেয়েটি।
অসহায়ের মতো বার কয়েক তাকালো এদিক সেদিক।
তারপর একসময় টুপ করে নেমে পড়লো প্লাটফরমে।
পরণে জিনসের প্যান্ট ও ফতুয়া।
পিঠে একটা বড় টুরিস্ট ব্যাগ।
স্টেশনের লোকজন বিস্মিত ও কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে তাকালো বার বার।
মেয়েটির পোষাক ও হাবভাবে বুঝলো, ও বিদেশী।
ট্রেনটা আবার হুইসেল বাজিয়ে ছেড়ে দিল হুশ্ হুশ্ শব্দ তুলে। এবং যেতে যেতে চলে গেল বহু দূর।
প্লাটফরমে দাঁড়িয়েই ট্রেনটির চলে যাওয়া দেখলো মেয়েটি।
তারপর তাকালো চারদিকে।
অনুভব করলো কেউ কোথাও নেই আপনজন।
এই অপরিচিত জায়গায় কেউ আসেনি আগ বাড়িয়ে, আসেনি এগিয়ে নিতে।
মেয়েটির নাম বাঁধন।
বিদেশী মেয়ের নাম বাঁধন একেবারেই বেমানান। তবুও নামটা ওর খুব পছন্দ। কারণ বাবা জাফর চৌধুরীর দেয়া নাম এটা। পোষাকী নামও ওর একটা আছে, জেনীফার। জেনী বলেই ডাকেন ওর বিলেতের মা হেনরিয়েটা।
মা জেনী ডাকলেও বাবার দেয়া বাঁধন নামটা ওর ভারী পছন্দ।
কেমন একটা শান্তি শান্তি ভাব।
স্টেশনের বাইরে এসে দাঁড়ালো বাঁধন। কয়েকটা রিক্সা দাঁড়িয়ে আছে প্যাসেঞ্জারের আশায়। ঠেলাগাড়িও আছে একটা।
রোদে দাঁড়িয়ে এরই মধ্যে রীতিমত ঘেমে নেয়ে গেছে বাঁধন। পিপাসাও পেয়েছে ভীষণ। পাশের ছোট্ট চায়ের দোকান থেকে পানির বোতল নিল একটা। জিজ্ঞেস করলো...।
: হাও মাচ ?... কতো?
হাসি হাসি মুখ দোকানীর।
ডান হাতের পাঁচ আঙুল দেখিয়ে বলল...।
: পাঁচ টাকা। ‘থ্যাংক ইউ’ বলে টাকা দিল বাঁধন। নতুন দেশ, নতুন মানুষ আর পরিবেশ চারদিকে। কয়েকজন রিক্সাওয়ালাকেই জিজ্ঞেস করলো বাঁধন।
: সাহেরখালি চৌধুরী হাউস?
: চৌধুরী বাড়ি?
: একজন বলল আসেন মেমসাব। একটা হুড খোলা রিক্সায় উঠে বসলো বাঁধন।
মাথায় ক্যাপ, চোখে সান গ্লাস, লম্বা ঘন বাদামী চুল, টক টকে ফরসা গায়ের রং রোদে আরো আলতা রং ধারণ করলো যেন।
রিক্সাওয়ালা একসময় বলল...।
: মেমসাব, রিক্সার হুট তুলে দেন, রোদে তো এক্কারে লাল অই গেছেন।
বাঁধন কি বুঝলো কে জানে, শুধু পানির বোতলে চুমুক দিল।
বলল...।
: ডোন্ট ওরি, আই এম ওকে।
রিক্সাওয়ালা বয়সে তরুণ, সুদর্শন। এক মুখ খোঁচা খোঁচা দাড়ি। মনে হয় কোন ভালো ঘরের ছেলে। গলায় ঝুলানো গামছা দিয়ে মুখের ঘাম মুছে। বললো—
মেমসাব আপনি না কইলেই কি, আর চিন্তা না করুম। দেখতাছি না গরমে আপনি কতো কষ্ট পাইতেছেন।
বাঁধন একটু কৌতূহলী হোল রিক্সাওয়ালার প্রতি...।
বলল...।
: ডু ইউ নো ইংলিশ? তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারছো। হোয়াট ইজ ইওর নেম?
নাম আমার বিজয়। আমার বাবার দেয়া নাম...।
বাবা তো মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন, কিন্তু আমাদেরকে জয়ী করে দিয়ে গেছেন।
বাবার দেয়া নামটা বুকে আঁকড়ে ধরেই সুদূর লন্ডন থেকে বাংলাদেশের এই... এই প্রান্তে এসেছে বাঁধনও।
এসেছে চট্টগ্রাম জেলার মিরসরাই এর সাগর তীর ঘেঁষা সাহেরখালি গ্রামের খোঁজে।
যে গ্রাম তার মুক্তিযোদ্ধা বাবা জাফর চৌধুরীর।
যে গ্রামের আলো হাওয়া আর গাছ গাছালির পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে বাবার গায়ের গন্ধ। আর সেই বাবার বিদেশে বড় হওয়া মেয়ে এসেছে এদেশের মাটিতে বাবাকে জানতে। তাঁর শৈশব কৈশোর আর উদ্ভাসিত প্রথম তারুণ্যের ইতিহাস জানতে।
পথ যেন আর ফুরোয় না।
ঝাপসা হয়ে আসে বাঁধনের দু’চোখ, দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল হয়ে এসেছে, কমে এসেছে রোদের তেজ।
বড় রাস্তায় ট্রাক, বাস, গাড়ির বেশ চলাচল, দু’ধারে অনেক দোকানপাট; এবার ডানদিকের গ্রামমুখী রাস্তায় নামলো রিক্সাটা।
বাঁধন যেন একটু চঞ্চল হয়ে উঠলো।
বলল...
: আমরা কি এসে গেছি। : কোন দিকে বাড়িটা—
বিজয় হেসে বলল...।
: এই রাস্তাটা হোলো সাহেরখালির রাস্তা, বাড়িটা আমি ঠিক চিনি না। তবে এই এলাকার লোকজন বলতে পারবে।
নিজামপুর কলেজের সামনে এসে থামলো রিক্সাটা। বেশ কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে ছিল রাস্তার ওপর...।
সদা হাসি মুখ বিজয়কে চেনে অনেকেই। বিদেশীনি প্যাসেঞ্জার ওর রিক্সায় দেখে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকালো অনেকেই; বাঁধন জিজ্ঞেস করলো।
: এটা কি সাহেরখালি?
চৌধুরী বাড়ি যাওয়ার রাস্তাটা কোন দিকে?
বিজয় বলল...।
: মেমসাব চৌধুরী বাড়িত যাইব।
কলেজ গেটে দাঁড়িয়ে ছিল সুদর্শন যুবক শাহেদ। এই কলেজেরই অধ্যাপক সে। চৌধুরী বাড়ির নাম শুনে এগিয়ে এলো রিক্সার কাছে। গভীর দৃষ্টিতে দেখলো সে মেয়েটাকে, একেবারেই অচেনা। তবুও চেনা চেনা চেহারার ছাঁট যেন আসে মেয়েটির মুখের আদলে...।
শাহেদকে কাছে এসে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল...।
: Do you know Chowdhury house?
শাহেদ মাথা ঝুকিয়ে বলল...
: ইয়েস—
ইয়েস! তুমি চেন...?
আবেগ আপ্লুত কণ্ঠ বাঁধনের।
শাহেদ আবার বলল—
: ইয়েস।
বাঁধন রিক্সার একপাশে সরে বসলো।
বলল...।
: প্লীজ, তুমি আমার সাথে চল।
শাহেদ একটু চুপ করে থেকে বলল।
: নো থ্যাঙ্কস, আমার সাথে বাইক আছে, তুমি যাও।
আমি আসছি।
: শিওর, থ্যাঙ্কস ইউ সো মাচ।
বলল বাঁধন।
ওকে নিয়ে রিক্সা এগিয়ে গেল গ্রামের পথে; বেলা তখন আরেকটু পড়ে এসেছে। বাঁধন মাথার ক্যাপ ও সানগ্লাস খুলে ফেলেছে। গ্রামের সোদা মাটির গন্ধ ভরা ভেজা বাতাস, ওর বুকের ভেতরটা কেমন যেন দুলিয়ে দিল।
বাঁধনের রিক্সাটা যতোই চৌধুরী বাড়ির কাছে আসতে লাগলো ততই ওর উত্তেজনা যেন বাড়তে লাগলো।
গ্রামের বৈকালি বাতাস যেন আলতো চুমু দিয়ে গেল বাঁধনের চোখে মুখে।
দু’ধারে ধান ক্ষেত, বাঁশঝাড় সরুখাল...
কিছু কিছু বাড়ি ঘর...
সব... সব যেন ওর বড় চেনা।
বাবার কাছে যেমন গল্প শুনেছিল এই গ্রামের।
বাড়ির প্রধান ফটক পেরিয়ে শাহেদের মটর সাইকেল বাড়ির উঠোনে দাঁড়ালো।
এসে ঢুকলো রিক্সাটিও। অসময়ে মটর সাইকেল ও রিক্সার টুন টুন শব্দ শুনে বেরিয়ে এলো বাড়ির ভেতরের মানুষগুলো। পুরুষ-মহিলা এবং কয়েকটি ছেলেমেয়ে। বিস্মিত দৃষ্টি সবার।
বাঁধন যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না যে, সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে... সুদূর লন্ডন থেকে বাংলাদেশের কোন এক গ্রামের শীতল মাটিতে সে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে আছে তার আসল ঠিকানায়।
একজন সৌম্যমূর্তি মহিলা।
এগিয়ে এলেন।
স্নেহমাখা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন।
: কে মা তুমি? কোথায় থেকে এসেছো?
বাঁধনের পা দু’টো তখন কাঁপছে।
টলছে চারদিক।
কোন রকমে কম্পিত কণ্ঠে বলল,
: আমি একটু বসতে চাই।
: নিশ্চয়, এসো...
মহিলা হাত ধরে ভেতরে এনে বসালেন বাঁধনকে।
চারদিকে ওকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে অনেকগুলো কৌতূহলী মানুষ। একজন এনে পানি দিল এক গ্লাস।
এতোক্ষণ চুপ করে সব দেখছিল শাহেদ।
এবার বলল...।
: নিজামপুর কলেজের সামনে এসে এই বাড়ির খোঁজ করছিল। তাই সাথে করে নিয়ে এলাম।
মহিলা এ বাড়ির বড় বৌ। শাহেদের মা সালেহা বেগম। বললেন।
: বলিস কি? এই বাড়ির খোঁজ করছিল?
: হ্যাঁ, মা। তাই সাথে করে নিয়ে এলাম। দেখ চেন কিনা।
বাঁধনের খুব কাছে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলেন সালেহা বেগম, ওর মুখটা তুলে ধরে কি যেন বুঝতে চাইলেন সন্ধানী দৃষ্টি দিয়ে। আপাদমস্তক ওর পাশ্চাত্যের চেহারা।
টকটকে ফরসা রং।
চুল আর চোখ বাদামী।
কিন্তু তারপরও খুব চেনা চেনা।
মুখের আদল...।
দু’চোখের ব্যথা আর অভিমানের একটা চাপা অভিব্যক্তি...।
বুকের ভেতরটায় কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো।
কখন আকাশে একটু একটু করে মেঘ জমতে শুরু করেছে টের পায়নি কেউ। ভেজা হাওয়া বইতে শুরু করেছে বাইরে। গাছ গাছালিতে শুরু হয়েছে অস্থির মাতামাতি।
ঝড়ো হাওয়ার স্রোত বয়ে যাচ্ছে বাড়ির ভেতরেও।
খোলা জানালা দিয়ে এধার থেকে ওধার পর্যন্ত।
চোখের সামনে দেয়ালে টাঙ্গানো এ বাড়ির দ্বিতীয় সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা জাফর চৌধুরীর তরুণ বয়সের ছবি।
বাঁধনের অপলক দৃষ্টি সেদিকে।
সালেহা বেগম আবার জিজ্ঞেস করলেন।
: বললে নাতো মা তুমি কে?
সন্ধ্যা আসন্ন।
আকাশে তখন ঘন ঘন মেঘ গর্জন ও বিদ্যুৎ চমক।
অবিন্যস্তভাবে উঠে দাঁড়ালো বাঁধন।
কম্পিত পদে গিয়ে দাঁড়ালো ছবিটার সামনে।
তারপর হঠাৎ কেঁদে উঠলো চিৎকার করে।
বলল...
: আমি জাফর চৌধুরীর মেয়ে বাঁধন।
কোথায় যেন বাজ পড়লো।
আর তারপরেই শুরু হোল অঝোর বর্ষণ।
বাঁধনের কান্না রোল মিশে একাকার হয়ে গেল অশ্রান্ত বৃষ্টির ধারার সাথে।
আবেগে কেঁদে ফেললেন সালেহা বেগমও।
: সত্যি...?
তুমি সত্যি আমাদের জাফরের মেয়ে। এ যে আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।
বাঁধনকে বুকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি।
ঘরের ভেতরে অন্যরকম এক পরিবেশ তখন।
আনন্দ-বেদনার এক মিশ্রিত কাব্য যেন।
বাঁধন এক সময় বলল...।
: লন্ডনে রোড এ্যাকসিডেন্টে মাম্মী-ড্যাডি এক সঙ্গে ডেথ হয়ে গেল।
আমি তখন একেবারে একা, নিঃসঙ্গ। একবার চিৎকার করে কাঁদতে পর্যন্ত পারলাম না। কার কাছে যাব ?
কোথায় যাব ?
: কদিন আমার এক বন্ধুর মা তার বাড়িতে রাখলো আমাকে। তারপর ?
সালেহা জানতে চাইলেন।
: কি তারপর?
বাঁধন আবার বলতে শরু করলো...
: তারপর নিজে নিজেই সিদ্ধান্ত নিলাম যে ড্যাডির দেশেই ফিরে আসবো আমি।
ড্যাডির কাছে তার দেশের কথা শুনেছি।
তিনি ফ্রীডম ফাইটার ছিলেন।
তাঁর কাছে দেশের গল্প শুনতে শুনতে মনে হয়েছে বাংলাদেশের সব কিছু আমার চেনা।
মাম্মীও বলতেন এই চৌধুরী বাড়ির কথা।
এক সময় খাওয়া দাওয়ার পর মা সালেহা বেগম—এর ঘরেই ঘুমিয়ে পড়লো বাঁধন।
আসলে ওকে অনেক আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন মা সালেহা বেগম। কিন্তু ঘুম এলোনা মায়ের চোখেও।
মুক্তিযুদ্ধের পর চারদিকে তখন আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে একদিন ফিরে এলো চৌধুরী বাড়ির মেজো ছেলে জাফর, হাতে স্টেনগান। চোখে মুখে বিজয়ের আনন্দ।
জীবন মরণপণ করে যুদ্ধ জয়ের আশায় বাড়ি ছেড়েছিল সে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এ ক্লাসের ছাত্র তখন। সামনে পরীক্ষা।
আরো অনেকের মতো ফাইনাল পরীক্ষা না দিয়েই যুদ্ধে চলে গেল জাফর।
বলেছিল...
: দেশ স্বাধীন করে তবেই পরীক্ষা দেব।
বাবা ইকবাল চৌধুরী গ্রামের সম্মানিত চেয়ারম্যান। সমীহ করে আট-দশ গাঁয়ের লোক। বড় ভাই জামিল চৌধুরী আদর্শ কলেজ শিক্ষক, সত্যিকারের একজন মানুষ গড়ার কারিগর।
ফৌজদার হাট ক্যাডেট কলেজে শিক্ষকতা করেন তিনি। নজির স্থাপন করেছিলেন একসময়। সবাই বলে আদর্শ মানুষ গড়ার কারিগর।
একটা সুখী আদর্শ পরিবার হিসেবে চৌধুরী বাড়ির সুনাম এবং সম্মান ছিল শ্রদ্ধার সাথে স্মরণীয়। 
সেই বাড়ির ছেলে জাফর।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষায় পাশ করে বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়তে চলে গেল।
লন্ডনে পড়তে পড়তে পরিচয় হয়েছিল পশ্চিমা মেয়ে হেনরিয়েটার সাথে।
তারপর প্রেম এবং বিয়ে।
খবরটা পেয়ে প্রচন্ড আঘাত পেয়েছিলো জাফরের বাবা, ভাই এবং ভাবী।
মা গত হয়েছেন আগেই।
কিছুদিন পর সেই অনাকাঙিক্ষত কষ্টটা বদলে গেল খুশীতে।
জাফর যখন হেনরিয়েটাকে নিয়ে বাংলাদেশে আসলো, তখন ওর প্রতি ধারণা বদলে গেল সবার।
বিশাল পরিবার, দিঘীর পাড়ে মস্ত বড় বাড়ি।
সীমানার চারদিকে সারি সারি নারকেল গাছ। বাইরে থেকে বাড়ির ভেতরের অবস্থানটা বোঝা একেবারেই দুঃসাধ্য। চৌধুরী বাড়ির পাঁচ ভাই—এর সবচে বড় ভাই-এর মেজো ছেলে জাফর। বাড়িতে ওর অবস্থানটা ছিল অন্যরকম।
বাড়ি ভর্তি চাচাতো, ফুফাতো ভাই-বোনদের সবার অনেক আদরের একটি ভাই ছিল সে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বহু পরিবারকে পুনর্বাসিত করতে সাহায্য করেছে।
সেই জাফর মেমসাহেব বৌ নিয়ে বাড়িতে এলো।
কেউ টু শব্দটি পর্যন্ত করলো না।
সবাই বলল...
আহ্ কি চমৎকার!
শাড়িতে যা মানিয়েছে...।
সবার সাথে মিশে গেছে একেবারে। মনেই হয় না বিদেশী বৌ। নিজ হাতে বেড়ে খাওয়াচ্ছে সবাইকে।
গাঁয়ের লোক ধন্য ধন্য করতে লাগলো। সবাই বলাবলি করতে লাগলো বড়ই পয়মন্ত বৌ। চৌধুরী বাড়িতে যেন আলো আর আনন্দের ফোয়ারা বয়ে দিয়েছে।
জাফর ভাবলো সত্যি কি সৌভাগ্য ওর হেনরিয়েটার মতো স্ত্রী পেয়েছে। মাত্র ক’দিনের মধ্যেই পরিবারের সবার মন জয় করে নিয়েছে সে; বিদেশী বিয়ে করে তাহলে ভুল করেনি জাফর। অনেক ক্ষেত্রে বাঙ্গালী বৌরাও এমন হয় না।
এলো বিদায়ের পালা।
দিন পনের থেকে সবাইকে কাঁদিয়ে জাফর বৌ নিয়ে ফিরে গেল কর্মস্থলে।
সেই সুখস্মৃতি এখনো জেগে আছে সবার মনে।
এরপর বার কয়েক  দেশে এসেছে জাফর হেনরি—এটাকে ছাড়াই।
বিদেশ থেকে প্রচুর টাকা পাঠিয়ে চৌধুরী বাড়ির চেহারা পাল্টে দিয়েছে সে। সবাই জানে সে কথা। বাঁধনের জন্মের পর ওর সুন্দর একটা ছবিও পাঠিয়েছিল জাফর। বহুদিন ছোট্ট বাঁধনের সেই ছবি সবার হাতে হাতে ঘুরেছে।
পরিবারের সবাই অপেক্ষা করেছে কবে আবার দেশে ফিরবে জাফর চৌধুরী স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে...?
কিন্তু আসা আর হয়নি ওদের।
বনমেরু ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিল জাফর। দুর্লভ এই রোগের চিকিৎসার খরচ জোগাতে গিয়ে সর্বশান্ত হয়ে পড়েছিল। জানে পরিবারের সবাই।
লন্ডনের মত দেশে থেকে মনের মত করে তৈরি করেছে একমাত্র সন্তান বাঁধনকে। বাংলাদেশে যে ওর শিকড় সেকথা ঢুকিয়ে দিয়েছে বাঁধনের মস্তিষ্কে। আর সেজন্যেই আট-দশটা বিদেশী মেয়েদের মতো বেড়ে ওঠেনি সে।
মুক্তিযোদ্ধা ব্যারিস্টার জাফরের সন্তান বাঁধন বাবার কাছেই শিখেছে বাংলা।
শুনেছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর কাজী নজরুল ইসলামের নাম। জেনেছে বাংলাদেশের গানের নাম ভাটিয়ালি ভাওয়াইয়া আর লালন।
সেই বাঁধন...।
সেই বাঁধন, এসেছে আজ তার শিকড়ের সন্ধানে... এই চৌধুরী বাড়িতে।
ছায়াছবির মতো সব কিছুই যেন দেখতে পান সালেহা বেগম। ভাবতে ভাবতে শেষ হয়ে আসে রাত। কান্না যেন আর শেষ হয় না।
চৌধুরী বাড়ির এই পরিবারের একজন মাত্র এখনো জীবিত আছেন, মমতাময়ী মা হয়ে এই সালেহা বেগম।
আর আছে তাঁর অধ্যাপক ছেলে শাহেদ। বিদেশের ডিগ্রী নিয়ে গ্রামের কলেজেই অধ্যাপনা করছে বাবার আদর্শকে সমুন্নত রেখে।
সেও আজকে তার মায়ের মতো সমানভাবে চিন্তিত ব্যথিত বাঁধনকে নিয়ে।
জানলার ধারে ইজি চেয়ারে বসে রাত ভোর করেছে শাহেদও...।
আকাশে একটু একটু করে সকালের রং ফুটছে।
রাতের কালচে মেঘ সরে গিয়ে গোলাপী আভা দেখা যাচ্ছে পূর্বের আকাশে। পাখি ডাকছে কয়েকটা। দরজা খুলে হাঁটতে বেরিয়ে গেল শাহেদ।
এটা ওর রোজকার অভ্যেস।
ফজরের নামাজের পরই বেরিয়ে যায় হাঁটতে।
কিন্তু আজকের দিনটা যেন একটু অন্য রকম।
বাঁধনের কথাটা বার বার মনে হতে লাগলো।
আজ আর বেশিদূর গেল না।
একটু ঘুরেই ফিরে এলো। এসে মায়ের ঘরের দরজায় দাঁড়ালো। দেখলো তখনো ঠায় বসে আছেন মা বাঁধনের পাশে।
দু’চোখ নিদ্রাহীনতায় ক্লান্ত।
নাকি সারারাত কেঁদেছেন মা সালেহা বেগম।
শাহেদকে দেখে, ঈশারায় ডাকলেন কাছে।
একটু পরেই নড়ে চড়ে চোখ মেললো বাঁধন। একটু অপ্রস্তুত হয়ে উঠে বসলো তাড়াতাড়ি।
রুক্ষ এলোমেলো চুল, চোখের  কোণে পানির দাগ।
ক্লান্ত বিষণ্ন চোখের দৃষ্টি।
হেসে সালেহা বেগম ওর মাথায় হাত বুলালেন।
বাঁধনের কাছে এসে দাঁড়ালো শাহেদ। উঠে দাঁড়ালো বাঁধন। তাকালো শাহেদের দিকে। কি যেন প্রশ্ন ওর বিস্মিত দৃষ্টিতে।
হাসি মুখে বাঁধনের দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিল শাহেদ।    
বলল...।
: আই এ্যাম ইউর ব্রাদার। তোমার ভাই, সো ডোন্ট ওরি !
: ব্রাদার !
ডান হাতে শাহেদের এগিয়ে দেওয়া হাতটা ধরলো বাঁধন। অন্য হাত মুখে চাপা দিয়ে উচ্ছ্বসিত কান্নাকে সামলাতে চাইলো বাঁধন। শাহেদও আবেগে আপ্লুত হয়ে বাঁধনকে আরো কাছে টেনে নিল।
অশ্রু সজল কণ্ঠে বলল...।
: তুমি আর একা নও। আমি, মা আমরা আছি তোমার সঙ্গে। কাঁদলেন মাও।
বললেন...।
: আমি রান্না ঘরে গেলাম। তুই বাঁধনকে নিয়ে নাস্তার টেবিলে আয়।
শাহেদ জানলা দিয়ে দেখলো আকাশে পুরোপুরি ভোরের আলো ফুটে উঠেছে।


 

পাঠকের মন্তব্য Login Registration