বিস্ময়জাগানো উপন্যাস

প্রতিনিধি | সাহিত্য

শুক্রবার ২২ ফেব্রুয়ারী ২০১৯|১৬:৪৯:৩৭ মি.



শেখ আবদুল হাকিম

এই বইমেলায় বেরিয়েছে মাসরুর আরেফিনের উপন্যাস আগস্ট আবছায়া। উপন্যাসটি পড়ে আমার জানা হলো যে বাংলা সাহিত্যের আকাশে এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের আবির্ভাব ঘটেছে এবং আমরা সবাই উচ্ছ্বাসে মাতোয়ারা হয়ে গর্ব করতে পারি তাঁকে নিয়ে। আমি কখনো জানিনি, এ দেশে এই সময়ে আমাদেরই কারও লেখা উপন্যাস আমাকে নিজের ভেতর টেনে নিয়ে এতটা আসক্ত করতে পারবে, কিংবা ভাবিনি, এই বিস্ময়জাগানো সাহিত্যরস আমার বুভুক্ষু আত্মার খোরাক হয়ে উঠবে। যদি কাউকে জানাতে চাই আগস্ট আবছায়ার ভেতর কী আছে, তাহলে গোটা বইটা উদ্ধৃতি হিসেবে ব্যবহার করতে হয়। প্রতিটি বাক্যে নতুন তথ্য, প্রতিটি প্যারায় চিন্তার খোরাক, প্রতি পৃষ্ঠায় চমক, পাতায় পাতায় বিচিত্র সব প্রসঙ্গ। এটা থ্রিলার জাতের কিছু না হওয়া সত্ত্বেও আপনি রুদ্ধশ্বাসে পড়বেন, এর মধ্যে রহস্য-রোমাঞ্চের সমস্ত উপাদান মুঠো মুঠো করে ভরে দেওয়া হয়েছে। পড়া শেষ হতে আমি আপ্লুত হয়ে পড়েছি, ‘আরে ভাই, আপনি তো ফাটিয়ে দিয়েছেন’ বলে অভব্য চিৎকার করতে চেয়েছি। আমি ঋণী, এবং এটা স্বীকার করার সময় মনে পড়ছে, এই বই আমাকে দুটো রাত প্রায় ঘুমাতেই দেয়নি।

দুনিয়া তাহলে খুনোখুনি করার একটা মঞ্চ? হিংসা, বিদ্বেষ, আক্রোশ, ঘৃণা চরিতার্থ করাই জীবন? বিশ্বসাহিত্য চষে ফেলা উপন্যাসের মূল চরিত্র এসব প্রশ্ন তুলে বলছেন, জীবনের অর্থ যতবার তিনি খুঁজে পান, সেটাকে প্রতিবার বদলে দেওয়া হয়। মানুষ আর তার নিয়তিকে চিরে চিরে দেখার দুর্মর এক স্বভাব নিয়ে এক ব্যক্তি ইনি, যার ভেতরে মারকাটারি একটা ভাবও দেখতে পাওয়া যায়।

শুরু থেকেই লেখার বিষয়বৈচিত্র্য, নায়কের জ্ঞানের পরিধি, দৃষ্টিভঙ্গির গভীরতা, বিস্ময় জাগানো পঠনপাঠন এবং এই দেশ যিনি স্বাধীন করেছেন, তাঁর হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে তীব্র ঔৎসুক্য আর উৎকণ্ঠা লক্ষ করে লোভী হয়ে পড়লাম, মনে আশা জাগল, এই বই আমাকে এমন কোথাও নিয়ে যাবে, যেখানে যাওয়ার নেশাটা বহুযুগ ধরে আমি লালন করছি।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড মেনে নিতে পারেননি তিনি, ১৫ আগস্ট তাঁর জন্যে প্রায় একটা অবসেশন হয়ে দাঁড়াল; বছর ঘুরে ওই তারিখ ফিরে আসছে দেখলে তিনি আর স্বাভাবিক থাকতে পারেন না, তাঁর ভেতর একটা জেদ চাপে, জন্ম নেয় একটা আক্রোশ; এবং এসব কারণে হত্যাকাণ্ডের ওই রাতে তিনি স্বয়ং সেখানে উপস্থিত হয়ে সব নিজের চোখে দেখে ফেললেন। আঙ্গিকে এ রকম বৈশিষ্ট্য আনতে গিয়ে দারুণ ওস্তাদির পরিচয় দিয়েছেন ঔপন্যাসিক, হৃদয়ের রক্তক্ষরণ অনুভব করার জন্য এই ফ্যান্টাসিটুকুর প্রয়োজন ছিল, ব্যক্তিগতভাবে সে জন্য আমি তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ।

নায়কের মনে প্রশ্ন এসেছে, তিনি সিজোফ্রেনিয়ার রোগী কি না, চোখের সামনে যা ঘটছে বলে জানেন, তা কি সত্যি, নাকি তিনি হ্যালুসিনেশনের শিকার; গোটা উপন্যাসে তাঁর উপলব্ধি করার চেষ্টা ছিল জীবন যেমন, জীবন কেন তেমন? উপন্যাসের উত্তমপুরুষ যেহেতু দর্শনের একজন অধ্যাপক, এবং জীবনজিজ্ঞাসা যেহেতু জাগরণের প্রায় সবটুকু সময় তাঁকে তাড়া করে ফেরে, তাই গল্পের ভেতর গল্প চলে আসে, সেসব গল্পে ফ্লবেয়ার থাকেন, তুর্গেনেভ থাকেন, প্রুস্ত চলে আসেন, কাফকা আর ক্লপস্টক চলে আসেন, আসেন পুশকিন আর লেরমন্তভ; তারপর মধুসূদন, শেকস্‌পিয়ার, বিভূতিভূষণ, অ্যারিস্টটল; আহ্, অ্যারিস্টটলকে কী এক হাত নিলেন তিনি! তাঁদের নিয়ে আসা হয়েছে জীবনকে জানার দুর্বিনীত কৌতূহল মেটাতে; তাঁদের জীবনদর্শন, তাঁদের ত্যাগ আর বন্ধুত্ব কেমন ছিল—বোঝার চেষ্টায়, মৃত্যুকে ছোবল মারতে দেখে তাঁদের মধ্যে কে বিদ্রূপ আর বিদ্বেষভরা হাসিটা হেসেছিলেন আহ্, সোনার খনি বলছি না কেন!

তাঁর প্রেম, যদিও তা ফ্রেমে বাঁধানো কিছু নয়, দুটো; আধুনিকতার সর্বশেষ সংস্করণ এই চরিত্র নেতিয়ে পড়া পুতুপুতু প্রেম করবে, সেটা কেউ আশা করে না, সুযোগমতো দুজনের সঙ্গেই শুচ্ছেন তিনি; তবে বলে রাখি যে তাঁরা দুজনই আমাদের নায়কের উপযুক্ত, বিশ্বাস না হয় বইটা পড়ে দেখুন, প্রমাণ পেয়ে যাবেন।

আমাদের এই নায়ক, বলা উচিত মহানায়ক, ১৯৭৫ সালের সেনাবাহিনী থেকে শুরু করে ওই সময়কার বাম রাজনীতি, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড, মানুষের জীবন, মানুষের মৃত্যু খুলে খুলে দেখেছেন। দেখেছেন চিরে, ফেঁড়ে, কেটে, ফাটিয়ে, ভাগ করে, ছিঁড়ে, টেনে, হিঁচড়ে, চৌচির করে, খুলে, মেলে; তারপর বোধ হয় আবিষ্কার করেছেন, ‘যেন বা মানবপৃথিবীর একমাত্র সত্য এটাই—হরর, হরর’।

আমার অপেক্ষার পালা ফুরোল, এখন তবে ‘টুঙ্গীপাড়া বিদ্রোহ’ পড়তে পারব।

পাঠকের মন্তব্য Login Registration